পর্ব : ৪৪
মধ্যযুগে হারেম
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: রামায়ণ মহাভারতের যুগে পতিতা সংবাদের একটু বিরতি দিয়ে এই পর্বে চলে আসি মধ্যযুগে।যেসময় রাজা বাদশা ও ধনীরা হারেমে পুষতেন দেশ বিদেশ থেকে ধরে আনা হয় মেয়েদের অধিকাংশই জয় করা দেশের নারী। হারেম শব্দের উৎপত্তি আরবি হারাম (অবৈধ) থেকে। তুর্কি ভাষায় যোগ হয় আর একটি শব্দ লিক। রাজ প্রাসাদের যে অংশে মহিলারা থাকেন তাকে বলা হয় হারেমলিক।হিন্দু বাঙালি সমাজে যাকে অন্ত:পুর বলে। অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালে নিরাপদ বাসস্থান। ইটালিয়ান ভাষায় বলে, সেররালিয়োন। যা ল্যাটিন শব্দ সেরা (গারদ) শব্দ থেকে এসেছে। ফরাসি ভাষায় সরাই মানে পান্থশালা। অর্থাৎ যেখানে পথিক সুরা ও সাকিসহ রাত্রিবাস করতে পারে। ভারতে প্রাচীন যুগে পালি ভাষায় বলা হতো স্ত্রী আগার। বৈদিক সাহিত্যে ব্রাহ্মণ্য উপনিষদে (৫০০ খ্রিস্টাব্দ)তে পুরুষের বহুগামিতার উল্লেখ মেলে। অবন্তীর রাজা প্রদেজ্ঞ,মগধের রাজা বিম্বিসার, অজাতশত্রু এবং স্বয়ং বুদ্ধদেবের সময়কালে রাজা উদয়নেরও হারেম ছিল। সুতরাং হারেম মানেই মুসলিম শাসকদের বহুগামিতা এই তত্ত্বের কোনও ভিত্তি নেই।
বৈদিক যুগের ঋষি কন্যা ইন্দ্রানী স্তোত্র রচনা করেছেন সতীনের হাত থেকে স্বামীকে নজর ফেরাতে।
পুরুষের বহু বিবাহ ঋকবেদের সমাজেও ছিল। পত্নীরা তাই সতীন জ্বালায় জ্বলতেন।দেবতাদের কাছে সতীনদের হাত থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানাতেন। এমনই সূত্র আছে ঋক বেদের দশম মণ্ডলের ১৪৫ নম্বর সুক্তে।যা নারী ঋষি ইন্দ্রানী রচনা করেছেন। সতীনদের ওপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা । অবশ্য বৈদিক ধর্মের শুরুতে নারীরও বহু পতিত্বের কথাও আছে। হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষণিক সময়ের এই নারীর অধিকারের বিষয়টিকে নারী স্বাধীনতা হিসেবে দেখিয়ে থাকেন।ঐতিহাসিকেরা বলেন, আর্যরা ভারতে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে যখন প্রবেশ করে সঙ্গে ছিল গুটি কয়েক নারী। মূলত তারা ছিল নর্তকী ও গুপ্তচর । ফলে যৌনতার প্রয়োজনে একজন নারীকে ভোগ করত পাঁচজন আর্য পুরুষ। এরপর এদেশীয় নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক যত বাড়লো তত আর্য সমাজে এক নারী বহু স্বামী প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে।
সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক ড: জে এল ব্রকিংটন তাঁর ন্যায়পরায়ণ রাম গ্রন্থে রামের বহুপত্নীর উল্লেখ করেছেন।
গবেষক প্রয়াত সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,_পুরুষের বহু বিবাহ ঋগ্বেদের সময় থেকে চলে আসছে; তবে ঋগ্বেদের সময়ে নারীরাও বহু পতিত্বে অধিকার ছিল। যদিও এ অধিকার সে অল্প কিছু কালের মধ্যেই হারায়। তৈত্তিরীয সংহিতা ও ব্রাহ্মণে পড়ি, যজ্ঞে একটি দণ্ডকে বেষ্টন করে থেকে দুটি বস্ত্র খন্ড, তাই পুরুষ দুটি স্ত্রী গ্রহণে অধিকারী, একটি বস্ত্র খন্ডকে দুটি দণ্ড বেষ্টন করে না,তাই নারীর দ্বিপতিত্ব নিষিদ্ধ।[তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৬/৪/৩, তৈ ত্তিরীয় ব্রাহ্মণ১/৩/১০/৫৮]। রামায়ণেও দশরথের এমন কি রামেরও বহু পত্নীর কথা শোনা যায়। সংস্কৃত সাহিত্যের ব্রিটিশ অধ্যাপক ড: জে এল ব্রকিংটন তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ন্যায় পরায়ণ রাম তে বলেছেন, দশরথ রামকে উত্তরসূরী ঘোষণা করতেই অন্ত:পুরে কৈকেয়ীকে দাসী মন্থরা বলে,এই খবরে রামচন্দ্রের রানীরা খুশি হবে ,তোমার পুত্রবধূ কষ্ট পাবে। এরপর রামচন্দ্রের যুবরাজ হিসেবে অভিষেকে শত্রুঘ্ন সাজাচ্ছেন রাম ও লক্ষণকে , কৌশল্যা সাজিয়েছেন রাঘবপত্নীদের আনন্দ বাজার পত্রিকা১/১০/৮৪)।
পর্তুগিজ পরিব্রাজক বারবোসা ভারত ভ্রমণে এসে লেখেন, হারেমের নারীদের কাছে পছন্দের পুরুষ পৌঁছে দিয়ে বখশিস পেত খোজারা।
মহাভারতেও দেখি পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীকে যেমন বিয়ে করেছেন সঙ্গে প্রত্যেক পাণ্ডব পুত্রদের একের অধিক স্ত্রী ছিল।এরপর মধ্য যুগেও সম্রাট বা সুলতানদের একের অধিক স্ত্রী ছিলেন।এদের দুএকজন পাট রানী।বাকি উপপত্নী।এঁদের নজরে রাখতেই খোজা রাখা হতো হারেমের পাহারায়। পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা ভারতে ছিলেন,১৫০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি লিখেছেন, মূলত বিজয়নগর (চট্টগ্রাম) থেকে বেশিরভাগ দাস সংগ্রহ করতো বণিকেরা।এই দাস বালকদের শুধু অণ্ডকোষ নয়, অনেকসময় পুরো পুরুষাঙ্গ কেটে নপুংসক বানিয়ে বাজারে বিক্রি হতো। ক্রেতা সমাজের ধনী শ্রেণী নয়তো রাজা উজিরেরা। পরবর্তী সময়ে (১৬০১_১১ খ্রিস্টাব্দ) পর্যটক ফ্রাঙ্ককোসিস পিয়ার্দও একই কথা বলেছেন। মূলত দরিদ্র মানুষ নিজের সন্তান বেচতেন অভাবের তাড়নায়। এই খোজারা কিন্তু হারেমের নারীদের কাছে পছন্দের পুরুষ পৌঁছে দিয়েও বকশিস পেত। দু তরফের বকশিস পেতে পেতে এরা যেমন লোভী হয়ে উঠত তেমন কিপটেও ছিল।কেননা তারা জানত বৃদ্ধ বয়সে জমানো অর্থই তাদের ভরসা।
দিল্লির সিংহাসনে সুলতান শামসুদ্দিন আলতমশ এক দাসীকে খাস বেগম বানিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন সাযযাদ কাদির তাঁর হারেমের কাহিনী , জীবন ও যৌনতা গ্রন্থের (দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, বাংলাদেশ) গ্রন্থে লিখেছেন, অন্ত্য বৈদিক যুগের আগে থেকেই সুস্পষ্ট শ্রেণীবিভাগ ছিল সেরাগলিয়োতে । তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে রাজসভার মহিমা বর্ধনকারী দ্বাদশ রত্নের মধ্যে রয়েছেন মহিষী(প্রধান রাণী) ববতা (প্রিয় পত্নী) ও পরিবৃক্তি (পরিত্যক্ত স্ত্রী)। এই বিভাজন থেকে বোঝা যায় রাজকীয় বহু বিবাহ ব্যবস্থায় ছিলেন তিনজন রাণীযাঁদের মধ্যে প্রাধান্য ছিল মহিষীর। এমন ব্যবস্থা চালু ছিল বুদ্ধদেবের সময়েও ( পূর্বাব্দ ষষ্ঠ শতক)।,,,,,, এই হিন্দু প্রথাটি পরবর্তী কালে গ্রহণ করেন মুসলিম শাসকরাও। শামসিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান শামসুদ্দিন আলতমশ দিল্লির সিংহাসনে বসেন ১২১০ অব্দে। তুর্কি ক্রীতদাসী শাহ তুরকান কে তিনি বানিয়েছিলেন খস বেগম। দান খয়রাত করে ওই বেগম পেয়েছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধার আসন।লেখক সাযযাদ কাদির তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, সকল বহিরাগতকে চোখ বেঁধে ঢুকতে হতো হারেমে।এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটতে দিতো না খোজারা। ( চলবে)।
আগামী পর্ব সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর,২০২৪