সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: একটা সময় ছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গভীর রাতে শোনা যেত নূপুরের ছন্দময় শব্দ? কারা নাচতেন? কেন নাচতেন। তথ্য বলছে, গভীর রাতে জগন্নাথদেব শয়নের আগে দেবদাসীদের নৃত্য উপভোগ করতেন। দেবদাসীদের পায়ের ছন্দময় নূপুরের ঝুম ঝুম আওয়াজ শোনা যেত। দেবদাসী ছিলেন কারা? সত্যিই কি মন্দিরে দেবদাসী নাচতেন? তথ্য বলছে, হ্যাঁ। এখন প্রকাশ্যে সেই দেবদাসী প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ দেবদাসী ছিলেন শশীমণি। ২০১৫ সালের রথযাত্রার কয়েকমাস আগে ২০ মে শশীমণি মারা যান ৯২ বছর বয়সে। মাত্র সাত বছর বয়সে উড়িষ্যার পঞ্চচৌরা গ্রামের বাসিন্দা শশীমণির মা বাবা মেয়েকে উৎসর্গ করেন প্রভু জগন্নাথকে। জগন্নাথের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সধবা নারীর মত সাবিত্রী ব্রত করতেন দেবদাসী শশীমণি। শশীমণির মৃত্যুর সাথে সাথে মন্দিরের চারশ বছরের দেবদাসী প্রথার সমাপ্তি ঘটে। যৌবনের সময়কাল ফুরোলে শশীমণির স্থান হয় পালিত পুত্র সোমনাথ , পুত্রবধূ উন্নারানী ও পড়ুয়া নাতি রাজার সংসারে ছ ফুট বাই পাঁচ ফুট এক সংকীর্ণ ঘরে।
দেবদাসী নাকি পুরোহিতদের সম্ভোগের বস্তু?
শশীমণি শেষবার নৃত্য পরিবেশন করেছেন প্রভু জগন্নাথের সামনে ২০১১ সালে। ধর্মের ষাঁড়েরগুঁতোয় কোমর ভেঙে গেলে তিনি বাতিল হয়ে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৩। উড়িষ্যা সরকার তখন মাসোহারার ব্যবস্থা করেন মাত্র হাজার টাকা। পুরীর রাজা দিতেন পাঁচশ টাকা । সোমনাথের আক্ষেপ ওই সামান্যটাকায় মায়ের উপযুক্ত সেবা করতে পারিনি। জগন্নাথ দেবের মন্দির সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল বৈষ্ণবীয় হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবে। সংঘাতও বেধেছিল আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাস ও লোকাচারের। ফলে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন কাল্ট। জার্মান পণ্ডিতদের আগ্রহের ফলে দুই পর্যায়ে ওড়িশা রিসার্চ প্রজেক্ট ( ৭০-৭৫) ও ১৯৭৮ সালে এক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সংশোধিত দ্বিতীয়সংকলন প্রকাশিত হয়। মোট ২৭ টি প্রবন্ধের সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সংযোজন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও পুরীতে জগন্নাথের দারু মূর্তির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কাহিনীর উৎস ও বিশ্লেষণ এবং তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে দুটি গবেষণাধর্মী রচনা। জগন্নাথদেবের পূজা, ওড়িয়া জাতীয়তাবাদী বাদ , মহিমা, ধর্মীয় অর্থনীতি , চৈতন্যদেবের প্রসঙ্গসহঅসংখ্য দুর্লভ ছবিযুক্ত দ্য কাল্ট অব জগন্নাথ অ্যান্ড দ্য রিজিওনাল ট্রাডিশন অফ ওড়িশা ( সম্পাদনা : অ্যান শার্লট এশম্যান, হেরম্যান কুলকে, গয়াচরণ ত্রিপাঠী) এই বইটি পুরীর মন্দির সম্পর্কে কৌতূহলী দের তৃষ্ণা মেটাবে।
এবার আসি মূল বিষয়ে। দেবদাসী অর্থ দেবতার দাসী। হরিবংশ পুরাণে দেবদাসীর বর্ণনা আছে। দেশের বিভিন্ন বিষ্ণু মন্দিরে দেবদাসীর উল্লেখ আছে। পুরীর মন্দিরের দেবদাসীদের সম্পর্কে জানার আগে দেবদাসীর ঐতিহাসিক তথ্য জানলে বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে সজায়ক হবে।এখানে সাহায্য নিচ্ছি সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমলা দেবী লিখিত ভারতীয় সমাজে প্রান্তবাসিনী,,,, গ্রন্থের দেবদাসী ও বিষকন্যা শীর্ষক নিবন্ধের।,,,,,,,,শৃঙ্গার মঞ্জরী গ্রন্থে ( পৃষ্ঠা ৫৭) বলা হয়েছে যে রূপসী লাবণ্য সুন্দরী তাঁর পালা এলে নেচে ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায় , সেকালে কোনো কোনো মন্দিরে একাধিক দেবদাসী থাকতেন। দেব মন্দিরে সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রচলন অতি প্রাচীনকাল থেকেই।,,,, কিছু নারীকে বিশেষত; তরুণীকে সেবায় উৎসর্গ করা হ’ত। উদ্দেশ্য ছিল,এঁরা নৃত্য গীত দিয়ে দেবতার প্রীতি সাধন করবেন? রাজারা নাচগান ভালোবাসতেন বলে লোকে মনে করত মানুষের প্রতিমূর্তি দেবগণও এর দ্বারা প্রীত হবেন।
মৃত্যুর কয়েকবছর আগে দেবদাসী পুরীর মন্দিরের শেষ দেবদাসী শশীমণি।
লেখকদ্বয় লিখেছেন,দেবদাসীরা মন্দিরেই থাকতেন। মন্দিরের কর্তৃপক্ষ তাদের ভরণপোষণ করতেন। কুট্টনীমতে(৫৬৩) আছ যে দেবদাসী ছিল ত্রিদশালয়জীবিকা; ত্রিদশ অর্থাৎ দেবতা। সময়মাতৃকায় (৮/৮৮) লিখিত আছে যে দেবদাসী দেবালয়ে সেবার বিনিময়ে খাদ্যশস্য পেতেন। এই গ্রন্থে (২/১৯) আছে যে একজন মন্দির কর্মচারীর সঙ্গে গৌরী মন্দিরের গর্ভগৃহে এক বেশ্যার সম্পর্ক ছিল।,,,,,,,,হিন্দু মন্দিরের মত বৌদ্ধ মন্দিরেও দেবদাসী থাকতেন। দশম শতাব্দী পর্যন্ত জৈন মন্দির সমূহেও দেবদাসী ছিলেন। দেবদাসীদের মেয়েরাও প্রায়ই দেবদাসী হতেন। তাদের জন্ম হ’ত এবং মন্দিরের চতু:সীমার মধ্যেই তারা লালিত হ’ত। কুট্টমীতে (৫৬৩) আছে যে এই বৃত্তি ছিল ক্রমোপগতা অর্থাৎ পুরুষাক্রমিক। যে কোনো লোকের মেয়েকে শৈশবে দেবতার সেবার্থে উৎসর্গ করলে সেও দেবদাসী হ’ত। যেমন রাজার মনোনীত ব্যক্তির সঙ্গে রাজবেশ্যা বাস করতেন, তেমন যে পুরুষ ভক্ত মন্দিরে অর্থদান করতেন , তাঁর সম্ভোগার্থে দেবদাসী থাকতেন।( পৃষ্ঠা ২৩৫/২৩৬) বৃদ্ধা হলে তখন আর মন্দির গর্ভগৃহে থাকার যোগ্যতা থাকত না। তাদের দিয়ে সুতো কাটানো হ’ত। বিনিময়ে জুটত দুমুঠো আহার। দেবদাসী প্রথায় কি পরিমাণে ব্যভিচার হ’ত জানাবো আগামীকালের কিস্তিতে।( চলবে)
আগামীকাল , সোমবার ৮জুলাই।