*
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ত্রিতিথির সন্ধিক্ষণে অনেক জাঁকজমক করেই এবার পুরীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা। উড়িষ্যায় এবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতায় আঞ্চলিক দলের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়েছে বিজেপি। মনে নিশ্চয়ই আছে উড়িষ্যার এক বিজেপি নেতা তো আনুগত্যের আবেগে বলেই বসেছিলেন স্বয়ং জগন্নাথ নাকি মোদীর ভক্ত। যাইহোক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এবার রথের রশি টানবেন। যদিও বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা ,৫ খন্ড, পৃষ্ঠা ১২১_১২২ এ বর্ণিত হয়েছে, বিবেকানন্দ বলেছেন ,জগন্নাথ একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির।,,,,,
বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা গ্রন্থে লিখেছেন, পুরীর মন্দির বৌদ্ধ মন্দির হিন্দু মন্দিরে বদলে নেওয়া হয়েছে।
এমন বৌদ্ধ আরও মন্দির হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করা উচিত। ড: নীহাররঞ্জন রায়,রমেশ বসু , অমলেশ ত্রিপাঠী, সহ অনেকেই বিবেকানন্দের বক্তব্যের সমর্থনে বলেছেন । সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও বলা যায় , অতীতের শাস্ত্রীয় তথ্য বলছে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে পুরীর মন্দির তৈরি হলেও তখন রথযাত্রা হতো না। সেই সময়ের জ্যোতির্বিদ শতনন্দের লেখা ধর্মশাস্ত্র বলছে, কুমার পূর্ণিমা, বলভদ্র জন্ম, কৃষ্ণাষ্টমি উৎসব হতো। শম্ভুকর বাজপেয়ী বা তাঁর পুত্র বিদ্যকর বাজপেয়ীর স্মৃতিশাস্ত্র গ্রন্থেও রথযাত্রা বা গুন্ডিচা মন্দিরের বিবরণ নেই। তেরশ শতাব্দীর শেষে লিখিত ব্রহ্মপুরাণে উল্লেখ আছে। সেই সময়ে সোম বংশীয় রাজা কপিলেন্দ্র দেব উৎকলের অধীশ্বর ছিলেন। ইতিহাসবিদেরা প্রশ্ন তোলেন, তৃতীয় অনঙ্গ ভীমদেবের সময়ে পুরীর শ্রী গুণ্ডিচা পালিত হতো কি? বিভিন্ন তেলেগু ভাষার শিলালিপি বিশ্লেষণ করে ইতিহাসবিদদের ধারণা, পুরীতে রথযাত্রার শুরু ১২২৩ খ্রিস্টাব্দের পর। শাস্ত্রমতে, রথযাত্রা নাকি জগন্নাথদেবের বিবাহের দিন। নীলাদ্রি মহোদয় গ্রন্থ বলছে, বাহুরা যাত্রা অর্থাৎ উল্টোরথে দেবমূর্তি মন্দিরে স্থাপিত হতো জগন্নাথ মূর্তি ছাড়া। জগন্নাথদেবের মূর্তি নিচে দক্ষিণমুখী করে রাখা হতো। লক্ষ্মীদেবীকে বসানো হতো উত্তরমুখী করে।অর্থাৎ মুখোমুখি। হতো শুভদৃষ্টি। দুজনের পোশাকের অঞ্চল বেঁধে দেওয়া হতো। বলরাম ও সুভদ্রা হতেন বরযাত্রী। এই বিয়ে হতো শবরদের আদিবাসী মতে।
নীলাদ্রি গ্রন্থে রথের দিনে জগন্নাথ ও লক্ষ্মীর বিয়ের দিন বলা হয়েছে
জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে বেরিয়ে রথে তিন বিগ্রহের গুন্ডিচার মাসির বাড়িতে আটদিন অবস্থান ও প্রত্যাবর্তন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে নবদিনাত্মিকা যাত্রা উৎসব নামে। এখন তিনটি রথ ব্যবহার হলেও সাতশ বছর আগে পর্যন্ত ছ’টি রথ ব্যবহার হতো। কেননা জগন্নাথ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি যেতে মাঝে ছিল এক নালা। নাম ছিল বলাগুন্ডি নালা। মন্দির থেকে তিনটি রথ আসত নালা পর্যন্ত। তারপর নৌকায় নালা পার হয়ে তিন বিগ্রহকে চাপানো হতো ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য তিন রথে। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা কেশরী নরসিংহপুরী রাজ্যভার গ্রহণের পর এই বলাগুন্ডি নালা বুজিয়ে দেন।
বাংলার পণ্ডিত জগন্নাথ তর্ক পঞ্চাননের(১৬৯৪_১৮০৭) বিধান ছিল, মদমত্ত বলরাম রথ থেকে পড়ে যাওয়ায় কোনও দোষ বর্তাবে না।
ওন্ড্রদেশ রাজ বংশাবলী গ্রন্থে বলা আছে, সেই নদীর নাম মালিনী। বালি দিয়ে রাজা সেই নালা বুজিয়ে দেন। সেই নালা বুজিয়েই এখন বড় রাস্তাটি তৈরি। সবশেষে এক মজার ঘটনা বলি। একবার রথযাত্রায় জগন্নাথ ,সুভদ্রা বিগ্রহ রথে স্থাপন করা হলেও বলরামের বিগ্রহ বসাতে গিয়ে বিগ্রহ পড়ে যায়। সকলেই অমঙ্গলের আশায় শঙ্কিত। মহারাজা গজপতি চলদবিষ্ণু উপস্থিত বাংলার ত্রিবেণী’র পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছে বিহিত চাইলেন। সবাই ভেবেছিল, পণ্ডিত যজ্ঞ, হোম প্রায়শ্চিত্ত করতে পুজোর বিধান দেবেন। কিন্তু বাংলার পন্ডিত পুরাণ ঘেঁটে বলেন, বলরামের মদ্যপানের অভ্যাস ছিল । সুতরাং মদ্যপায়ী কেউ পড়ে গেলে যেমন আমরা আবার তুলে ধরি, তেমন বলরাম বিগ্রহ আবার তুলে রথে বসালেই হবে। ছোট ভাই জগন্নাথের বিয়ের বরযাত্রী ও বর কর্তা বলে কথা। একটু মদ্যপান না করলে চলে? পণ্ডিতের বিধানে সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তবে পরে পুরীতে সেই বছর কোনো অমঙ্গল ঘটেছিল কিনা,ইতিহাসে তার উল্লেখ মেলেনি।