পর্ব :২ ( শেষাংশ)
হিন্দু শাস্ত্র মৈত্রায়নী সংহিতায় নারী অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। এমনকি নিজের দেহকেও অবাঞ্ছিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করারও অধিকার দেওয়া হয়নি।
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : নারী তাঁর অস্তিত্ব রক্ষায় নিজের অধিকারটুকুও পায়নি ধর্মীয় শাস্ত্রে। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখছেন, বারবার বলা হয়েছে, যে নারীর সভায় যাওয়ার অধিকার নেই ( মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪/৭/৪; কোনো শিক্ষা পাওয়ার ধন অর্জন বা স্বাধীনভাবে ভোগ করার, এমনকি নিজের দেহটিকেও অবাঞ্ছিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবারও অধিকার তার নেই।( মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩/৬/৩;৪/৬/৭;৩/৭/৪;১০/১০/১১; তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২: ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, পুত্র হলো সর্বোচ্চ স্বর্গের প্রদীপ আর কন্যা। হল দুঃখের। কারণ। ( ঋকবেদ: ১০/৩৯/১৪)
হাবার্ট স্পেন্সার বলেছেন, উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি প্রেত চর্চার মধ্য দিয়ে।
বৈদিক সাহিত্যে দীপদান মহোৎসব একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। কার্তিক মাস দীপদানের মাস। গৌড়ীয় ব্রাহ্মণেরা এই মাসকে দামোদর মাসও বলে থাকেন। ঋতুকালের বিচারে সময়টা হেমন্ত। প্রয়াত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার সময়। হাবার্ট স্পেন্সার বলেছেন, উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি প্রেত পুজোর মধ্য দিয়ে। যা আসলে পূর্ব পুরুষদের উপাসনা। আদিম মানুষ মনে করত মৃত পুরুষদের আত্মারা তুষ্ট থাকলে বিপদে তাঁরা রক্ষা করবে। এই সময়েই তাই ইংল্যান্ড ও নর্দান আয়ারল্যান্ড , আমেরিকায় পালিত হয় হ্যালোউইন উৎসব। সে প্রসঙ্গ আলাদা। কথা হচ্ছে ভাইফোঁটা নিয়ে। শাস্ত্রকাররা বলেন, ষড়ঋতুর মধ্যে এই হেমন্তকালেই দেবী বসুন্ধরা শান্ত মনে থাকেন।সুতরাং পরলোকের বাসিন্দারা পৃথিবীতে আসেন আপনজনের কাছে তৃষ্ণার জল চাইতে। তাঁদের আকাশ পথে দিশা দেখাতে ছাদে জ্বালানোর প্রথা আকাশ প্রদীপ। আজকাল অবশ্য বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার বাড়ায় পরলোকগত আত্মাদের অসুবিধে হচ্ছে না যাতায়াতের। তাই আজকাল আর তেমন আকাশ প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে না।
ধর্মের প্রতীক যমরাজ? যিনি মাকে পদাঘাত করেন?
প্রথা মেনে আজও পুরুষের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করে ভাইফোঁটা পালিত হচ্ছে নিষ্ঠা ভরে। বিখ্যাত সেই ছড়া। যমুনা দেয়, ভাই যমকে ফোঁটা, আমি দেই আমার ভাই/ দাদাকে ফোঁটা। অর্থাৎ যম ও যমুনা এখানে দুই প্রধান চরিত্র। কে এই যম? কে যমুনা? পুরাণ মতে, যম দক্ষিণ দিকের দিকপাল। সূর্যের ঔরসে ও সংজ্ঞার গর্ভে জন্ম। বৈবস্বত মনুর ভাই। বীর্য বমনকালে সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে সংজ্ঞা তাঁর ছায়াকে স্বামী সূর্যের কাছে সঁপে পালিয়ে বাঁচেন। যথা সময়ে যমের জন্ম হয়। ছায়া সন্তান পালনে ছিলেন অমনোযোগী। যম তাই ধাত্রী মাকে পদাঘাত করেন। ছায়াও পাল্টা যমকে অভিশাপ দেন, যে পা দিয়ে যম মাতৃসমা নারীকে আঘাত করেছেন সেই পা ক্ষত ও কীটযুক্ত হোক। তাই হলো। পিতা সূর্য পুত্র যমের অবস্থা দেখে ক্ষতস্থানের পুঁজ ও কীট ভক্ষণের জন্য একটি কুকুর দেন। সেই চিকিৎসায় যম সুস্থ হন। কিন্তু পা দুটি হয়ে যায় দুর্বল। প্রতিবন্ধী বলা যায়। ফলে মহিষের মত শক্তিশালী জীবকে বাহন করেন। কিন্তু বিয়ের পাত্রী পেতে সমস্যা হয় নি। তাও আবার একজন নয়। দক্ষ রাজের ৪০ টি কন্যারব ১৩ জনকে বিয়ে করেন। বাকি ২৭ জনের বিয়ে হয় চন্দ্রের সঙ্গে। বেশ কিছু সন্তানও হয়।
যমরাজকে ফোঁটা দেন যমুনা। আবার ভাইয়ের সঙ্গে যৌনতা কামনা করেন?
যমপুরীর নাম সংযমনী। নারী অবমাননা করলেও যম সবচেয়ে পূণ্যবান। মানুষের জীবনে শান্তি দেন। তাই আরেক নাম শমন। জীবনে অন্ত আনেন। তাই আরেক নাম অন্তক। যমের দেহের রং সবুজ। রক্তবর্ণ পোশাক। দুই অনুচর। মহা চন্দ ও কালপুরুষ। পুরাণ মতে, পৃথিবী থেকে যমলোকের দূরত্ব ৮৬০০০ যোজন। ঋকবেদে যমকে কিন্তু দেবতা মানা হয় নি।বলা হয়েছে দেব সহচর। যমের বোন যমুনা। সূর্যের যমজ সন্তান। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তের চৌদ্দটি শ্লোকে আছে এক নির্জন দ্বীপে যমের কাছে সহবাস প্রার্থনা করছেন যম ভগ্নী যমুনা। তিনি বলছেন, বিস্তৃত সমুদ্র দ্বীপে ভ্রাতা তোমার সঙ্গে সহবাস ইচ্ছা প্রকাশ করছি। কিন্তু যম বলেন, এটা অজাচার। অর্থাৎ অজ মানে ছাগল। বুদ্ধিহীন, নীতিহীন ছাগলের কাজ মানুষের করা সাজে না।যমুনা পাল্টা জবাব, বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা মাতৃগর্ভেই তাঁদের মিলনের সূচনা করেছেন। গর্ভে যদি একত্রে শয়ন করা যায়, তো গর্ভের বাইরে সম্ভব নয় কেন? তবু নাকি যম রাজি না হওয়ায় ক্রুদ্ধ যমুনা চলে যান সেই স্থান থেকে। পরে ফিরে এসে দেখেন বৃক্ষতলে যম শায়িত। দেহে প্রাণ নেই। যমের কোনো কাহিনীতে ভাই ফোঁটার কোনো প্রসঙ্গ নেই।
যম ও যমুনার পবিত্র ভাইবোনের সম্পর্ক? তবে এই প্রণয়চুম্বন কেন?
কিন্তু ভাষ্যকরেরা দাম্পত্যের দুই চরিত্র পুরুষ ও নারীকে বলেছেন যম ও যমী। একান্তই যা স্বামী স্ত্রী। বৈদিক শব্দকোষ পাণিনিও এই কথা স্বীকার করেছেন। আবার অন্য কিছু শাস্ত্রে যম ও যমীকে বলা হয়েছে আগুন আর পৃথিবী। বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক শাখা ব্রজসত্ত্ব। সেখানে যৌথ মূর্তি যম ও যমীকে আলিঙ্গন রত অবস্থায় দুজনকে চুম্বনরত দেখানো হয়েছে। যম দেবতা নন, আগেই বলেছি। মৃত্যুর পর যম হলেন দিকপাল। নরকের রাজা। যমের বিরহে যমুনা কাঁদতে কাঁদতে নদীতে পরিণত হন। এরপর নাকি কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামের জেদে বলরামের স্ত্রী হতে বাধ্য হন যমুনা। ইতিমধ্যেই যম মনুষ্য জন্ম পরিত্যাগ করে দেবতা নরকের রাজা হয়েছেন।যমুনার আমন্ত্রণে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় আসেন বোনের শ্বশুরবাড়ি। সেখানে ভাইকে বরণ করেন বোন যমুনা। প্রশ্ন উঠতে পারে, সুভদ্রা অর্জুনের মাসী। কৃষ্ণ মামা। কেননা কুন্তীর ভাই কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কিন্ত সুভদ্রার ফোঁটা নিয়েছেন তেমন তথ্য নেই। পুরীর জগন্নাথ যে সুভদ্রার কাছে ফোঁটা নেন তেমন কথাও শোনা যায় না। যম ও যমুনা যেহেতু হিন্দু মতে পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী তাই ভাইফোঁটার লৌকিক উৎসবে ধর্ম এসে জুড়ে যায়। ফোঁটা বিষয়টা যদি একটি সুস্থ সুন্দর প্রতীকী হিসেবেও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু যম যমুনা আখ্যান এই পবিত্র সম্পর্ককে কতটা গৌরবান্বিত করে সেভেবে দেখার বিষয়।
তবে শাস্ত্রে ভাই বোনের সহবাস সম্পর্ক যে নিষিদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। পুরাণে ব্রহ্ম কন্যাকে ব্রহ্মা পুত্র দক্ষের বিয়ের কথা আছে। পুরাণে পূষণ- অচ্ছোদা, অমাবসু, পুরু – কুৎসা ও নর্মদা, বিপ্রচিতি ও সিংহিকা, নহুষ – বিরজা, শত্রু – ঊষানস, অংশুমত ও যশোদা, দশরথ – কৌশল্যা ভাই বোন দাম্পত্যের কথা আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে ও অর্ধম্যাধী ভাষায় জৈন সাহিত্যেও ভাই বোনের বিয়ের কথা আছে। রামায়ণে রামের এক দিদি ছিলেন, শান্তা যাঁর নাম। রামকে তিনি ভাইফোঁটা দিয়েছেন এমন তথ্য নেই। মহাভারতে দ্রৌপদীর সবই পুত্র। সুতরাং সেখানেও ভাইফোঁটার গল্প নেই। দুর্গার চার পুত্র কন্যা হিসেবে যাঁদের পেয়েছি তাঁদেরও ভাইফোঁটার কোনো কাহিনী পুরাণে নেই। তবু ভাইফোঁটা শুধু বাংলায় নয়, দেশ জুড়েই পালিত হয়। মণিপুরে বলে হিয়াং সেই। এই তিথিতে বিবাহিত নারীরা আসেন বাপের বাড়ি। উত্তরভারতে ভাই দুজা। নেপালে ভাইটিকা। গুজরাটে ভাইবিজ। অন্ধ্র প্রদেশে চিলেলা পাংডাগা । শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় এই লৌকিক উৎসবকে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াস থাকলেও তেমন প্রভাব বিস্তার করা যায়নি, বিভিন্ন শাস্ত্রকারের বিপরীত ব্যাখ্যার জন্য ,একথা বলাই যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক বড় ঐতিহ্য ভাইফোঁটা।( শেষ)