রবীন্দ্রনাথও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন?

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ৮ মে, ২০২৪ দেশজুড়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হবে দেশজুড়ে। বিদেশেও হবে জন্মদিন পালন।বংশগত ঐতিহ্যে যেহেতু রবি কবি বাঙাল , সেহেতু বাংলাদেশেও রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালিত হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক মানুষ দু দেশের জাতীয় সংগীতের জনক সেই সম্মানও তো একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই প্রাপ্য। জমিদার বংশের মানুষ রবীন্দ্রনাথ। খাওয়া পরার কোনো অভাব ছিল না। বহু স্বজন মৃত্যুর দুঃখ তিনি পেয়েছেন। আবেগকে প্রশ্রয় দেননি। তবু কেন তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন? আত্মহত্যার ইচ্ছা কেন হয়? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গে ৮ থেকে ৮০ সব বয়সের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রামায়ণ বলছে কাব্যের তিন প্রধান চরিত্র রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ তিনজনই আত্মহত্যা করেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণ বলছে , রামের। অর্থাৎ পারিবারিক ধারা। বিজ্ঞান বলছে, পারিবারিক জিন থেকেও আত্মহত্যার প্রবণতা মেলে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নাকি আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আত্মহত্যা বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। এটা প্রমাণিত, ঘটনাগুলি মোটেই বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। দীর্ঘমেয়াদি হতাশা, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ জীবনের ইতি ঘটাচ্ছেন। মনোবিদরা এর বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন। দ্রুতগতির জীবনযাত্রায় আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি । গত দুবছরের করোনা পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বয়স্করা যেহেতু জীবন যুদ্ধে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তাই জীবনের ব্যর্থতাকে স্বাভাবিক ভেবে নিতে পেরেছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির হাত ধরে নির্মাণ হাজারও পণ্য সুখের ঘরের হদিশ দিয়েছে, সে সবকিছুই সহজে মেলা যায় এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ছেন। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বা পেশাদারী ক্ষেত্রেও দক্ষতার অভাব বোঝেন না। নিজের অদক্ষতাকে বিশ্লেষণ করেন না।
এঁরা ভেবে বসেন, আমার প্রতিভার কদর করার মত কেউ নেই। ক্রমাগত এই হতাশা শেকড় গেড়ে বসে মনের অন্দরমহলে।আবার এটাও ঠিক, যোগ্যতা থাকা সত্বেও অযোগ্যদের চোরা পথে সাফল্য পেতে দেখে নিজের পরাজয়ের গ্লানি মুছতে অনেকে আত্ম হননের পথ বেছে নেন। মনোবিদরা এই ফোবিয়া থেকে তৈরি হতাশাকে অ্যাটিকিফোবিয়া বলছেন। পরীক্ষার ভীতির কথাই ধরা যাক। স্কুল কলেজের পরীক্ষার ফল ভালো হবে না,বা ভালো হলো না, তাই অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে বসেন। যা ডিপ্রেশনেরই ফলশ্রুতি। চাকরির ক্ষেত্রেও অনেকে উত্তীর্ণ না হতে পারার টেনশন থেকে আত্মহত্যা করে বসেন।

রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছিলেন।

বিনোদন জগৎ গ্ল্যামারে মোড়া, তাই এই দুনিয়ার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ কোনও অস্বাভাবিকতা নয়। সেখানেও ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। নতুন প্রজন্ম ভেবে দেখে না ,পরীক্ষার আর এক নাম জীবন যুদ্ধ। সেই জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে যেমন দক্ষতার প্রয়োজন , তেমন প্রয়োজন নিজের প্রতি আস্থা। সেই আস্থায় যদি কোনো সন্দেহ থাকে, মনে তখন তৈরি হয় অস্তিত্ব সংকটের ভয়। মনস্তত্ত্ব বলছে, ব্যর্থতা ভীতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে, ক্যারোক্রাফিওফোবিয়া। এই ধরনের ফোবিয়া মনে বেমন একটা ধারনা তৈরি করায়, যা অকাট্য।

অর্থাৎ ব্যর্থতা মানেই জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে স্মৃতিতে থাকা কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ওপর ট্রমাটিক প্রভাব ফেলে। এই ফোবিয়া অনেক ক্ষেত্রে বংশগতও হতে পারে।

হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা

সমীক্ষা বলে,পড়াশুনোর চাপে প্রতি ৫৫ মিনিটে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে ভারতে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আগামী ৩ জুন রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ঘোষণা হতে চলেছে । জানি না , এবারেও অসফল কোনো পরীক্ষার্থী আত্মহত্যার মত অবিবেচক সিদ্বান্ত নেন কিনা। ২০১৫ সালেই হু জানিয়েছিল, এশিয়ায় জাপান,ভারত ও সিংহলে নবীন প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। জাপানে আত্মহত্যা একসময় ছিল উৎসব। বলা হয় হারিকিরি। প্রাচীন যুগ থেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত জাপানে হারিকিরি ছিল স্বাভাবিক । আসল শব্দ সেপ্পেকু।১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাপানে হারিকিরি নিষিদ্ধ হলেও ১৯১২ সালে জাপানের বিখ্যাত রাজা মিইজির মৃত্যুতে তাঁর সেনাপ্রধান হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেন । ১৯৯৯ সালে টোকিওতে এক সরকারি কর্মী উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যবহারে অপমানিত হয়ে হারিকিরি করেন।
বছর চারেক আগে জাপানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে টুইটার কিলার তাকাহিরো শিরাইশি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে আদালতে তোলা হলে সে জানায়, আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা অনুচিত। আমি যে নয়জনকে মেরেছি,তারা প্রত্যেকেই স্যোশাল মিডিয়ায় আত্মহত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। সুতরাং তাদের খুন করে আমি কষ্টে থাকা মানুষদের সাহায্য করেছি । আজ শুধু জাপান নয়, বিশ্বজুড়েই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। সমীক্ষায় পিছিয়ে পড়া ভারতেও নতুন প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছাত্রছাত্রী ছাড়া যাঁরা বিনোদন জগতে জড়িত বা সংস্কৃতি জগতে জড়িত তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার ইতিহাসও বহুদিনের।সমীক্ষা বলছে,বিশ্বে প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে কমপক্ষে ২২০০ মানুষ।এঁদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ।বিশ্বে ১০ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। লাতিন শব্দ সুই সেই ডেয়ার শব্দ থেকে ইংরেজি সুইসাইড শব্দের সৃষ্টি । অর্থ নিজেই নিজেকে হত্যা করা।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আত্মহত্যা প্রবণতার শিকার হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ইউনানী ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে তাঁর শারীরিক সমস্যা দূর হলেও কিছু মানসিকউপসর্গ দেখা দিয়েছে। মেটেরিয়া মেডিকা পড়ে নিজের সেই সব উপসর্গ চিহ্নিত করলেন রবীন্দ্রনাথ। অবসাদ, মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা,কান্নার তাগিদ, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতা, আক্রোশ ইত্যাদি। রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে, মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ। অথচ এক বছর আগেই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার কিছুদিন পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাম দেন আত্মা। সেখানে তাঁর স্বীকারোক্তি, আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলুম দুবার। জীবনের জটিলতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলুম। অথচ এই রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,মানবের মাখে আমি বাঁচিবারে চাই। প্রখ্যাত দার্শনিক নাট্যকার সেনেকা আত্মহত্যা করেন ছাত্র রোম সম্রাট নিরোর নির্দেশে। ভার্জিনিয়া উল্ফ। বিশ্বখ্যাত লেখিকা। ডিপোলার ডিজঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর আত্মহত্যার কায়দা ছিল অদ্ভুত। তিনি ওভারকোর্টের পকেটে ভারী পাথর ভরে খরস্রোতা নদীতে ডুব দেন। দিন কুড়ি পর তাঁর গলিত শবদেহ উদ্ধার হয়। রুশ কবি ও নাট্যকার মায়াকোভক্সি যিনি আমরণ শ্রেণী সংগ্রাম এর কথা বলেছেন। ১৯৩০ সালে ১৪ এপ্রিল প্রণয় সম্পর্কের জটিলতায় রিভলবার দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি উপন্যাসে বলেন ,মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্ত পরাজিত হয় না। সেই হেমিংওয়ে মানসিক ও শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ১৯৬১ সালে মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে ট্রিগার টেপেন। মাথার ঘিলু উড়িয়ে গুলি বেরিয়ে আসে। শিল্পীদের আবেগপ্রবণ মন সামান্য নেতিবাচক পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে না। এমন বহু আত্মহত্যার ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে ইতিহাসে।

কানাডার রয়াল অটোয়া হাসপাতালের গবেষকরা বলেছেন, পরীক্ষায় দেখা গেছে , নিউরো ট্রান্সমিটার রিসেপ্টর জিনের বিভাজনে আত্মহত্যার প্রবণতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই রিসেপ্টরের নাম ৫_এইচ টি ২ এ। এটা মস্তিষ্কের রাসায়নিক উপাদান সেরোটনিন থেকে সংকেত বহন করে। হৈমন্তী এক গভীর রাতে অশ্বথ গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা এক মানুষের কাছে কবি জীবনানন্দের অমোঘ জিজ্ঞাসাই আমরা যদি প্রতিধ্বনি করি, তাহলে বলতে পারাই যায়,জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের তোমার অসহ্য বোধ হলো; মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো?মর্গে গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মত রক্তমাখা ঠোঁটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *