পর্ব ৬
সুজিৎ চট্টরাজ: গতকাল শনিবার ৬ এপ্রিল ২০২৪ ৫ম পর্বে বলেছিলাম সংশোধনী আইনের মাধ্যমে হিন্দু উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান শব্দটার মধ্যে একটা কথার জাগলারি আছে। পরিকল্পনা করেই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। শুনলে মনে হবে মানবিকতার এক পরাকাষ্ঠা। এই আপাত দৃষ্টিতে একটি সরল বাক্যের মধ্যে কতটা গরল আছে বুঝতে একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।একটা সদ্য স্বাধীন দেশে কে নাগরিক আর কে নাগরিক নয় তা স্থির করা স্বাভাবিক। সেহেতু ভারতের সংবিধানে ৫ নং ধারায় কে বা কারা সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিন থেকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবেন তা জানিয়ে দেওয়া হয়। সংবিধানের ৫ এ ধারায় বলা হয়েছে , যে কেউ ভারতে জন্ম নিলে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তিনি ভারতীয় নাগরিক হবেন।৫ বি ধারায় বলা আছে, যে কারুর মা বাবার মধ্যে অন্ততঃ একজন ভারতে জন্মেছেন ও ভারতে স্থায়ী বাবে বসবাস করছেন তিনিই ভারতের নাগরিক।৫ সি ধারায় বলা হয়েছে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে থেকে যে কেউ অন্ততঃ ৫ বছর ভারতে বিশ্বাস করেন তিনিই ভারতীয় নাগরিক। এই ধারার বাইরেও আরও কিছু মানুষকে ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ভারতীয় নাগরিক হিসেব সংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই স্বীকৃতি আছে সংবিধানের ৬ এ ও বি এবং আই ধারায় । সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অথবা কোনো ব্যক্তির বাবা , মায়ের বা ঠাকুরমার মধ্যে অন্তত একজন যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন এবং তিনি যদি পাকিস্থানভুক্ত এলাকা থেকে ১৯৪৮ সালের ২৯ জুলাইয়ের আগের দিন পর্যন্ত মাইগ্রেশন করে ভারতে এসে থাকেন এবং তারপর থেকে ভারতে বসবাস করেন তবে তাঁকে সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হবে। সংবিধানের কাট অব ডেট ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই। তার আগে যারা ভারতে এসেছেন বা বসবাস করছেন তারা ভারতীয়। এই তারিখের পর যারা এসেছেন তিনি ভারতীয় নাগরিক নন , যদি না আবেদকরে ভারত নাগরিকত্ব অর্জন করা হয়ে থাকে।
স্বাধীনতার পর বিষয়টি ধামা চাপা অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ আইনত ভারতীয় নাগরিক ও বেআইনি ভাবে থাকা অনাগরিক ভোট দিয়ে দেশের বিধায়ক , সাংসদ ও পুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। আবার সাংসদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি, উপ রাষ্ট্রপতি। অনাগরিক অর্থ বিদেশি।আবার সংবিধানগতভাবে বিদেশি নাগরিক যদি পাসপোর্ট ভিসা বা বৈধ নানুমতচারা ভারতে আসেন তিনি অনুপ্রবেশকারী। সংবিধানের ২(১) খ ও খ (২) ধারায় আছে। ফলে বিদেশি অর্থ মূল ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশিদেরও বোঝায়। হিন্দু, মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বৌদ্ধ সবাই বিদেশিদের তালিকায়।১৯৯৯ সালে বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।২০০৩ সালে তিনি নতুন নাগরিকত্ব বিল সংসদে পাশ করিয়ে আইনে রূপান্তরিত করেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি মেলায় এই আইন ২০হিন্দুরাই দেশভাগের বশিকার নন০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে কার্যকরী হয়। এই আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন ধারা সৃষ্টি হয় যেখানে দেশান্তরিত উদ্বাস্তু মানুষদের সর্বনাশ সূচিত হয়। এই আইনের ২(১) খ ধারায় অনুপ্রবেশকারী সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে যারা অনুপ্রবেশকারী তারা কোনো মতেই ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করতে পারবে না ।
মূলত হিন্দুরাই দেশভাগের শিকার হয়েই দেশান্তরিত হয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হন। তাই বিজেপি শাসিত তৎকালীন সরকার হিন্দুদেরই অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করে।২০০৩ সালে আইনের আর একটি মারাত্মক ধারা দেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে বা তার পরে যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে নিজের জন্ম সার্টিফিকেট সহ বাবা এবং মা দুজনেরই ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র জরুরি। নতুবা তারা ভারতী নাগরিকের কোনো অধিকার বোনেন না। অর্থাৎ আজকের যে সব নতুন প্রজন্ম ভারতে জন্মেছে তাদের মা বাবা নাগরিকত্বের প্রমাণ না দেখাতে পারলে এই সব সন্তানেরাও বেনাগরিক।২০০৩ সালে এই আইনে ১৪ এ ধারা নামে একটি ধরাও যুক্ত হয়েছে! সেখানে বলা হয়েছে প্রতিটি রাজ্য এন আর সি বা নাগরিক পঞ্জি করতে বাধ্য। বিজেপি বিরোধী দলগুলি এই আইনের বিরোধী । রাজ্যের শাসক দল বলছে তারা এই এন আর সি বা সি এ এ মানবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কোনো আইন পাশ করালে রাজ্য সরকার মানতে সাংবিধানিক ভাবে মানতে বাধ্য। তাহলে উপায়? ( চলবে)