শব্দবাজির ত্রাসে আপনি ও আপনার পোষ্য মারাত্মক টিনাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : শারদ উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই হেমন্তের হৈমন্তিক ঋতুর বরণ দেওয়ালি উৎসব দিয়ে। এবারের উৎসবে বাংলায় প্রকৃতি ছিল বিরুদ্ধ। তাই শব্দ বাজির তাণ্ডব ছিল কম। তবে কালীপুজোর রাতের বয়স যত বাড়বে, বাজির দাপট তত বাড়বে ।পুলিশ সূত্রের খবর , কয়েকবছর ধরেই বেলেঘাটা, কসবা, সিঁথি, কাশীপুর, যাদবপুর ইত্যাদি এলাকায় দাপট বেশি। যদিও পুলিশ বহু কেজি নিষিদ্ধ বাজি যেমন আটক করছে, তেমন আটক হবে অনেকে। বহু ক্ষেত্রে পুলিশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ দফতর আইনি ব্যবস্থাও নেবে। দূষণ দফতরে অভিযো জানিয়ে ফোনও আসবে। কিন্তু জনসচেতনতা না বাড়লে শুধু আইন দিয়ে কিছু হবে না

শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গা থেকেও অভিযোগ আসে। আদালতের নির্দেশে ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ বাজির প্রতি যেমন নিষিদ্ধ ,তেমন পরিবেশবান্ধব শংসাপত্রহীন আতশ বাজিও নিষিদ্ধ। কিন্তু সবুজ বাজির তকমা সেঁটে বহু এলাকায় পোড়ানো হয়েছে নিষিদ্ধ বাজি। তবে গতবছর গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টি থাকায় বাতাসের দূষিত ধুলিকণা বোঝা বেসম্ভব হয়নি। দিল্লিতে স্থানীয় আপ সরকার গত বছরে সব ধরনের বাজির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তাই নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়ে যায়। বিজেপি এই সিদ্ধান্ত হিন্দু বিরোধী বলে আখ্যা দেয়। আপ সরকার সেসব গ্রাহ্য করেনি। তাঁরা ঘোষণা করেই দিয়েছিল , কেউ বাজি নিয়ে গ্রেপ্তার হলে ছ মাসের জেল ও দুশো টাকা জরিমানা হবে। বাজি বিক্রি করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও তিন বছর জেল হবে। কিন্তু কতটা সমস্যা সুরাহা হয়েছিল?
সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য আপ সরকারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বিজেপি সাংসদ মনোজ তেওয়ারির সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন খারিজ করে দেয়। কালী পুজো বা দিওয়ালির উৎসবের অঙ্গ হিসেবে শব্দ বাজির ব্যবহার একটি প্রাচীন প্রথা। শব্দই ব্রহ্ম, এই জ্ঞানে মানুষ মেতে ওঠে শব্দবাজি পোড়াতে। কিন্তু শব্দ বাজির শব্দ ব্রহ্ম যে শুধু মানুষের ব্রহ্ম তালুতে ব্যাঘাত ঘটায় শুধু নয়, পশুপাখিরাও আক্রান্ত হয়। বাড়ির পোষ্য সারমেয় বা রাস্তার ব্রাত্য সারমেয় শব্দের আতঙ্কে ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়। পোষ্যরা খাটের তলায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও মুক্তি কই? প্রতি বছর এই সময় ডাক্তারের ক্লিনিকে শব্দ বাজিতে আক্রান্ত মানুষের ভিড় বাড়ে। আদালতের নির্দেশে শব্দবাজির মাত্রা ৯০ থেকে বেড়ে ১২৫ ডেসিবেল হয়েছে। একদিকে মাইকের চিৎকার অন্যদিকে বিভৎস শব্দবাজির আওয়াজ এই জোড়া আক্রমণে শব্দ ও বাতাসের দূষণ মানবিকতার হত্যা। সমীক্ষা বলছে, দেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ ও পোষ্য প্রাণীদের টিনাইটিস নামে এক রোগের শিকার হতে হয়। এই রোগে শ্রবণশক্তি কমে যায়। বজ্রপাতে বা শব্দ বাজিতে কুকুর যে ভীত হয়, তাঁকে বলে অ্যাস্ট্রোফোবিয়া।কুকুরের প্রতি নির্দয় ব্যবহার এক শ্রেণীর মানুষের অভ্যাস হলেও পুরাণের গল্পে কুকুরের এক বিরাট ভূমিকা আছে। মহাভারতে স্বয়ং ধর্মরাজ কুকুরের ছদ্মবেশে মহাপ্রস্থানের পথ দেখান। শিবের এক রূপ কালভৈরব। তাঁর বাহনও কুকুর। শুধু হিন্দু শাস্ত্রেই নয়, মিশরের দেবতা ছিলেন কুকুর দেবতা আনুবিস। আজও সিকিম , ভূটানে কুকুরের পুজো হয়। গ্রীক পুরাণে লায়েলপস ছিল এক কুকুর। যা গোল্ডেন হাউন্ড নামে পরিচিত। ভবিষ্যত শাসনকর্তাদের রক্ষার ভার ছিল এই কুকুরদের।

মধ্যপ্রদেশে কুকুরের মন্দির।


বৈদিক ধর্মে কুকুরকে বলা হয়েছে শ্বন। দেব দত্তাত্রেয় শাস্ত্রে চার কুকুরকে চার বেদের প্রতীক বলা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের বেতুল জেলায় কুকুরের মন্দির আছে। শিব পুরাণে বলা হয়েছে, সতী দেহ ছিন্ন হওয়ার পর শিব যখন প্রকৃতিস্থ হলেন, যমকে দিলেন যজ্ঞের অনুমতি,তখন শিবের প্রতি উৎসর্গকৃত স্বাহা শিবের আদেশ গ্রহণ করেছিল এই কুকুরই। মার্কন্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, বিশ্বামিত্র মুনি প্রবল মন্ন্বন্তরে খিদের জ্বালায় জীবন ধারণ করেন কুকুরের মাংস খেয়ে। দেবরাজ ইন্দ্র তখন বিচলিত হয়ে বারিধারা বর্ষণ করে পৃথিবীকে শস্য শ্যামলা করেন। রামায়নেও রামচন্দ্র এক কুকুরকে বিনা কারণে আঘাত করার জন্য এক ব্রাহ্মণকে অভিশাপ দেন।দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বেঙ্গালুরুতে রয়েছে কুকুরের এক মন্দির। বেঙ্গালুরু থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে চান্নাপাটনায় রামনগর জেলার অগ্রাহারায় আছে সেই মন্দির।

ছত্রিশগড়ে কুকুরের মন্দির।


ছত্রিশগড়েও দুর্গ জেলায় খপড়ি গ্রামে রয়েছে আরও একটি মন্দির। তৈরি হয়েছিল সম্ভবত ১৪/১৫ শতকে।আমাদের যা ফিসফিস শব্দ,কুকুরের কাছে তা হাজার ওয়াট।আমাদের কাছে যা ৪০ ডেসিবেল তা কুকুরের ২৪০ ডেসিবেল। সেক্ষেত্রে ৯০ ডেসিবেলে কুকুরের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গরুরও শব্দবাজিতে অক্সিটোসিনের ক্ষরণ বাড়ে। দুধ দেয় কম। বহু পাখি মরে যায়। ডিম ফেটে যায়। অন্ধ্র প্রদেশের আর্কুভ্যালিতে ২০১৯ সালে শুঁয়োপোকার বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। শব্দবাজির প্রেমিকরা কি একবার ভেবে দেখবেন না? কবি সুকান্ত কি অহেতুক বলে গেছেন, এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি নবজাতকের কাছে, এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *