কোলাহল থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাট্যসন্ধায় নাটকের বই শিলার জান্নাত প্রকাশ

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কেরালার পর্যটন বিভাগ কেরালার নাম দিয়েছেন ঈশ্বরের আপন দেশ। বিবেকানন্দের ভারত ভ্রমণের তালিকায় ছিল কেরালা। কেরালার কিছু ধর্মীয় কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে ভূমিপুত্রদের ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণের ছবি প্রত্যক্ষ করে তিনি বলেছিলেন কেরালাম ভান্থালায়ম। অর্থাৎ পাগলের দেশ। কেরালা পাগলের দেশ নাকি দেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী রাজ্য সেই বিতর্ক রাজনীতিবিদদের জন্য তুলে রেখে বলা যায় জন্মগতভাবে কেরালিয়ান রক্তের বাহক নাইজেল আকারা সত্যিই পাগল। পাগল না হয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়? ঘরে ঘরে তবু নাইজেলের মত ছেলে জন্মায়। কেননা বনের মোষ তাড়াতে তিনি শুধু নিজের ঘরটুকু রক্ষা নয়, গোটা সমাজের ঘরকে রক্ষা করার সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ জারি রেখেছেন। হ্যাঁ। নাইজেল কথার অর্থ কালো। ল্যাটিন নিজেলাস চার্চ থেকে নেওয়া হয়েছে। কালো শব্দটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। কিন্তু নাইজেলের আরও অর্থ আছে। নাইজেল শব্দের সমার্থক ব্যাপ্তির অর্থ চ্যাম্পিয়ন, নায়ক।২১ বছর বয়সে অপহরণের দায়ে ১৭ টি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবাস। সোনা পুড়লে খাঁটি হয়। নাইজেল সংশোধনাগারে থাকাকালীন দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটস থেকে মানবাধিকার বিষয়ে স্নাতকোত্তর হন।

এরপরের তাঁর জীবনের চলার পথ সবারই কম বেশি জানা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে অভিনয় । বাংলা শেখা।থিয়েটার থেরাপির অন্যতম ,সৈনিক। জার্মানির ভিয়েনার চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র মনোবিদ জ্যাকব লিভি মোরিনো ১৯২২ সালে প্রমাণ করেন মানসিক স্থিতির অভাবে শুধু হাসপাতাল, ওষুধ, মনোবিদ শেষ কথা নয়। থিয়েটারকেও মাধ্যম করা যায়। এরপর ১৯৫০ সালে নাট্যকর্মী ও পরিচালক অগুস্ত্ বোওয়াল ব্রাজিলে কাজ শুরু করেন। এদেশে সেই ধারার স্রষ্টা নাইজেল আক্কারা। ইতিমধ্যেই সমাজের ব্রাত্য যৌনকর্মী , বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, ও রূপান্তরকামীদের দিয়ে নাট্ক মঞ্চস্থ করেছেন। এখন প্রস্তুতি চলছে অ্যাসিডে আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে নাট্য নিবেদন।এর ফাঁকে

শুক্রবার কলকাতার সংস্কৃতির পীঠস্থান রবীন্দ্রসদন নাইজেল তাঁর হাতে নির্মাণ কোলাহল থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ করলেন অষ্টম নিবেদন শিলার জিন্নৎ নাটকটি। এদিনের অনুষ্ঠানে নাটকটির বইএর প্রকাশ ঘটল কবি সুবোধ সরকারের হাতে। নাটকটির রচয়িতা ও নাটকে ভাস্কর ইসমাইলের বড় বোনের চরিত্রের শিল্পী সর্বানী ঘোষ বসু। শিল্পী ইসমাইলের চরিত্রে আসিফ ইকবাল। দুজনের অভিনয়ে মৌলিকত্ব ছিল। সুগন্ধার চরিত্রে সায়ন্তনী মুখার্জি। ছোট্ট শিল্পী মুস্কানের চরিত্রে উপাসনা বর ছোট্ট চরিত্র হলেও পাড়ার পুজো কমিটির দুই সদস্য রঘু ও লক্ষ্মণের চরিত্রে অম্বরীশ দাস ও সঞ্জু দাস। যেটা না বললেই নয়, নাটকটি দৃশ্য , সঙ্গীতে , আলোক সম্পাতে অম্বরীশ দাস,প্রঞ্জা দত্ত ও সৌমেন চক্রবর্তীর কুশলী নির্মাণ। শব্দ নিক্ষেপে বন্ধন মিশ্রকেও বাদ দেওয়া অপরাধ হবে।

নাটকটি বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক বসুধৈব কুটুম্বাকম অবলম্বনে। নাটকটির রচয়িতা মূল ভাবনাকে অনুসরণ করে বলেছেন , শিল্পীর কোনো জাত নেই। প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের পরিচয় শুধুই সামাজিক। একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকেই যদি বিশ্বের সব নারী পুরুষের সৃষ্টি , তবে কেন জাতের নামে বজ্জাতি? কিছুটা পুনর্জন্মের অবৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে শিল্প যখন নারী মূর্তি সুগন্ধা হয়ে ওঠে ইসমাইলের মনে পড়ে পূর্বজন্মে সে ছিল রাজপরিবারের সদস্য ভাস্কর রবি বর্মা। বাস্তবেও রবি বর্মা কেরালারই ভুমিপূত্র।সময়টা ১৮৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল। কাকতালীয় ভাবে তাঁর জন্মদিনের দুদিন আগে তাঁকে নিয়েই নাটক মঞ্চস্থ করলেন পরিচালক নাইজেল আক্কারা। নাটকটি দেখতে গিয়ে বোঝা যায় জীবনে সাংস্কৃতিক পট নির্মাণে নাইজেল ক্রমশ পরিণত হচ্ছেন।পাশ্চাত্যের বাস্তব চিত্রশৈলীর সঙ্গে ভারতীয় পুরাণের চরিত্রের সংমিশ্রণের নির্মাণে রবি বর্মার অনবদ্য শিল্পের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর শৈল্পিক ছোঁয়ায় অবগুণ্ঠনে নারী আলো আঁধারি মায়ায় এক রক্ত মাংসের মানবী হয়ে উঠত। স্থান কাল পাত্র ভুলে তিনি তাঁর সৃষ্টি স্থায়ী রূপ না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতেন না। এই দুটি বিষয় নাটকে আলো নিয়ন্ত্রণে যেমন গুরুত্ব পেয়েছে তেমন ইসলামের শিল্পী চরিত্রটিও সেই তথ্যকে অনুসরণ করেছে।

১০ মিনিটের বিরতির পর দ্বিতীয় পর্বে অভিনীত হল ছোটদের নাটক উড়ুক্কু মানুষ। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল আর খুশির দেশের চরিত্রের সঙ্গে নাট্যকারের সম্পর্ক স্থান পেয়েছে। বাস্তব আর কল্পনাকে যুগলবন্দি ঘটিয়ে সৃষ্টির বিন্যাসে মেতেছেন নাট্যকার ।নিটোল মজার গল্পে রয়েছে একটি সামাজিক বার্তা। তাই বুঝি নাটকের এক দৃশ্যে অ্যালজেব্রার সূত্র যখন শুনি শিউরে উঠতে হয় দেশের সংকটকে অনুভব করে। ছোট ছোট বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের রীতিমত পেশাদার শর্তে পারিশ্রমিক দিয়ে নাইজেল উড়ুক্কু মানুষ নাটকটি কোলাহল থিয়েটার ওয়ার্কশপ উপহার দিয়েছে। নাইজেল সাংস্কৃতিক সংঘর্ষকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেশাগত ব্যাবসা করেন , সেই অর্জিত টাকায় প্রযোজনা।তেমনই সমাজসেবী হিসেবে আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান সাধ্যমত। নাইজেলের এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাকে একটু খোলা মনে সাধুবাদ না জানালে নিজেরাই কিন্তু ব্রাত্য হয়ে যাবো নিজের কাছেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *