ভারতের ত্রিদেব। নেহেরু, রাজা গোপালচারী ও প্যাটেল
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমি চক্রবর্তী রাজা গোপাল আচারিয়া যথাবিধি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি ষষ্ঠ জর্জ , তাঁর বংশধর এবং উত্তরাধিকারীদের প্রতি আইনানুসারে বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকব এবং আমি চক্রবর্তী রাজা গোপাল আচরিয়া শপথ নিচ্ছি যে আমি গভর্নর জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত থেকে সম্রাট জর্জ , তাঁর বংশধর এবং উত্তরাধিকারীদের সুচারু ও যথাযথ ভাবে সেবা করব।( দ্র: ফ্রিডম অফ ইন্ডিয়া : এ , হোক্স)।
এবারে ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। আস্ত একটা ছুটির দিন। নেতারা গতকাল রাত থেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন কে কত বড় দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে। দিল্লির লাল কেল্লা থেকে প্রগতিশীল ভারতের ফিরিস্তি দেবেন প্রধানমন্ত্রী তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে একবারও মনে করবেন না তাঁর আদর্শের নায়কেরা একদিন তেরঙ্গা পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতিতে অসম্মত ছিলেন। ফিরে যাই রাজা গোপালচারী ও গভর্নর জেনারেল প্রসঙ্গে। আশ্চর্যের বিষয় গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া মেরুদন্ডহীন বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিককূল কিংবা প্রতিবাদী বামপন্থী ও লোহিয়াপন্থী সমাজবাদী রাজনৈতিক নেতারা প্রশ্ন তুললেন না দেশের গভর্নর জেনারেল হিসেবে রাজা গোপালচারী ইংরেজ শাসকদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে শপথ নিলেন কবে? ১৯৪৮ সালের ২১ জুন। তার আগে এই পদে কে ছিলেন ? লর্ড মাউন্টব্যাটেন। মাউন্টব্যাটেন কে ছিলেন? লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ব্রিটিশ রাণী এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মামা.। ষষ্ঠ জর্জের রাজত্বে তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পান।১৯৪৭ সালের২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। ব্রিটেনে তখন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি । গভর্নর জেনারেল পদটির মাহাত্ম্য কি ?
গভর্নর জেনারেল পদটি একটি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সাংবিধানিক পদ। ব্রিটিশ অধীনস্থ উপনিবেশেগুলির শাসন ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা প্রধান কাজ। উপনিবেশে কোনও বিদ্রোহ যেন মাথাচাড়া না দিতে পারে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উপনিবেশের অন্তর্গত সমাজের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতা দখল রাখার কাজ সুষ্ঠু ভাবে পালন করা। ব্রিটিশ রাজ মুকুটের প্রতিনিধি তিনি। ভারতে গভর্নর জেনারেল নিযুক্তির কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল।১৭৭৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস হন প্রথম গভর্নর জেনারেল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে ভারত নামক উপনিবেশ অর্থাৎ কলোনী রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরাসরি যখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের করায়ত্ত হল তখন প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন চার্লস জন ক্যানিং। তাঁকে ভাইসরয় উপাধিও দেয় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র। এই ধারা বজায় ছিল ১৯৪৭ পর্যন্ত।কি কারণে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ভারতকে সরাসরি উপনিবেশ থেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত করল সে এক লম্বা ইতিহাস। সেই প্রসঙ্গে অনেক বিতর্ক আছে। তবে এটা একশ শতাংশ সত্যি যে ১৫ আগস্ট মধ্য রাতে জহরলাল নেহেরু কোনও স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নায়ক হিসেবে শপথ নেননি। তিনি শপথ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ অনুগত একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের । শব্দের ম্যাজিকে বোঝানো হল এটাই স্বাধীনতা দিবস।১৫ আগস্ট যদি স্বাধীনতা দিবস হয় তবে কি করে একজন ব্রিটিশ নাগরিক লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সংবিধানের সৃষ্ট পদ গভর্নর জেনারেল হিসেবে থেকে যান? প্রশ্ন তুলবেন না। তিনি যে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত।তাছাড়া বলাই তো আছে, কথা বোলো না, কেউ শব্দ করো না। ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন। গোলযোগ সইতে পারেন না।
মাউন্টব্যাটেনের স্নেহধন্য ভারতরত্ন রাজা গোপালচারী।
রাজাজী এই পদে ছিলেন ১৯৪৮ সালের ২০ জুন পর্যন্ত। ইতিমধ্যে নথুরামের গুলিতে গান্ধীজি প্রয়াত হন ৩০ জানুয়ারি। এরপর মাউন্টব্যাটেন ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে এই ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সাংবিধানিক পদের দায়িত্বভার অর্পণ করে যান রাজগোপালচারীকে। অবশ্যই কংগ্রেসের নেতাদের সম্মতিক্রমে। এই পদে রাজা গোপালচারী মনোনীত হওয়ার পেছনে কারণ কি ছিল? কারণ ছিল অনেকগুলি। প্রথমত তিনি কংগ্রেসের পুরানো নেতা। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রিমিয়ার ছিলেন। এসবই ব্রিটিশ শাসনে। এরপর ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ অধীনস্থ অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প, সরবরাহ, শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন।তিনি ছিলেন গান্ধীজির সম্বন্ধী। কেননা গান্ধীজির ছোট ছেলের সঙ্গেই রাজা গোপালচারী নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মতাদর্শগত কারণে ক্ষমতা লাভের কারণে নেহেরু গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিরোধ। তবু ব্রিটিশ রাজের নেকনজরে ছিলেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্যে ভালো দখল। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষ চন্দ্র বসুর মত চরমপন্থী নেতার চরম বিরোধিতায় জন্য ব্রিটিশের করুণা লাভ করেছিলেন।
ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এত মধুর ছিল যে মাউন্টব্যাটেনের ভাগ্নে প্রিন্স ফিলিপের সাথে ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়ে প্রিন্সেস এলিজাবেথের বিয়েতে যোগ দেন। এহেন ব্যক্তিকে ব্রিটিশরাজ গভর্নর জেনারেল বানাতে নেহেরুকে রাজি করানোর ভার দেয় মাউন্টব্যাটেনকে। কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার না হলে রাজা গোপালচারী হতেন প্রথম রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যে আম্বেদকরের নেতৃত্বে দেশের সংবিধান রচনার কাজ শুরু ।১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের গণপরিষদে আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবিধান গৃহীত হয়।২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে কার্যকর হয়। যতক্ষণ না দেশের নিজস্ব সংবিধান কার্যকর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীন দেশ বলার কোনো যুক্তি আছে কি? রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা কেন চুপ?
ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট গ্রন্থে আছে অনেক বিষ্ফোরক তথ্য।
ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যটেন প্ল্যান ঘোষণা করবেন। ডমিনিক ল্যাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স রচিত ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট গ্রন্থে বলা হয়েছে ১৯৪৭ সালের ২ জুন রাতে মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের নেতাদের সঙ্গে দুটি পৃথক মিটিং করেন। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ছিলেন জহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল ও আচার্য কৃপালিনি। মুসলীম লীগের পক্ষে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী খান ও আবদুররাব নিশতার। ছিলেন শিখ প্রতিনিধি বলদেব সিং। লক্ষণীয় বৈঠকে গান্ধী নেই। সেখানেই তিনি পরিষ্কার ৮ দফা সিদ্ধান্ত জানান। প্রধান সিদ্ধান্ত ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা ডোমেনিয়ান হবে। অর্থাৎ একটি উপনিবেশ ভেঙে দুটি উপনিবেশ। গঠিত হবে দুটি গণপরিষদ। মধ্যরাতে আরেকটি সভায় অবশ্য গান্ধীজি উপস্থিত থাকলেও চুপ করেছিলেন। কারণ? তিনি নাকি প্রতি সোমবার মৌনব্রত পালন করেন। দিনটি ছিল সেই সোমবার।
গান্ধীজি ও গোপালচারীর ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। গান্ধীজির ছোট ছেলের শ্বশুর গোপালচারী।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিন্ত প্রথমে ঘোষণা করেছিলেন,১৯৪৮ সালের ৩০ জুন ভারতের নেতাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে দিনক্ষণ এগিয়ে আনা হয়। মাউন্ট ব্যাটেনের
মনে ধরে ১৫ আগস্ট দিনটি। কেননা ১৯৪৫ সালে এই দিনে জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই ঘটনার কৃতিত্ব ছিল মাউন্টব্যাটেনের। মনে রাখা দরকার ওইদিনই জাপানের আত্মসমর্পণে নেতাজির ভারত গড়ার স্বপ্ন ধাক্কা খায়। সে অর্থে দিনটি বাঙালি বা দেশপ্রেমী মানুষের কাছে শোকের দিন।
ইংল্যান্ডে কমনওয়েলথ সম্মেলনে চার্চিল ও নেহেরু।
১৯৪৭ এ আমরা ১৫ আগস্ট স্বাধীন হলাম। তবে কেন ৪৯ সালে নেহেরু কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে ইংল্যান্ড গেলেন? কমনওয়েলথ সম্মেলন তো ব্রিটিশ উপনিবেশ দেশগুলির সম্মেলন। আমরা প্রশ্ন করিনি ৪৭ সালে যদি স্বাধীন হয়ে থাকি তাহলে কেন ১৯৭১ সালে ২৯ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকাযসংবা প্রকাশ হল ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট থেকে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল ও লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের সরকারি বাসভবন ও গাড়িগুলিতে ব্রিটিশ রাজের পতাকার বদলে দেশের পতাকা থাকবে। এতদিন কেন ব্রিটিশ রাজার পতাকা উড়ল? সরকার পাল্টেছে। এখনও কেন নেতাজি যুদ্ধপোরাধী বা ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে ওয়ান্টেড? ব্রিটেনের কমিউনিস্ট নেতা রজনীপাম দত্ত তাঁর বই ইন্ডিয়া টুডে তে লিখেছেন, ভরতের জনগণের কোন সার্বভৌম ক্ষমতা নেই এবং ইন্ডিপেন্ডেন্স কথায় প্রশ্ন তুলে বলেছেন আমাদের পাশের দেশ বার্মা স্বাধীন। কিন্তু আমরা পরাধীন। এই বইয়ের প্রকাশক পেঙ্গুইন। অমিতাভ মৈত্র এই প্রসঙ্গটি আলোচনা করেছেন বর্তমান দিনকাল পত্রিকায় ১৯৮২ সালের জুলাই সংখ্যায় ২৬ নং পৃষ্ঠায়। এই প্রসঙ্গটি আবার লিপিবদ্ধ করেছেন গোলাম আহমাদ মোর্তজা তাঁর এ এক অন্য ইতিহাস গ্রন্থে যে প্রশ্নের উত্তর নেই অধ্যায়ের ২৫৫নং পৃষ্ঠায়। প্রকাশক, বিশ্ব বঙ্গীয় প্রকাশন, একাদশ মুদ্রণ , জানুয়ারি ২০১৯
ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট নেতা রজনীপাম দত্ত তাঁর ইন্ডিয়া টু ডে গ্রন্থে লিখেছেন ভারত কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়।