গাজন ও চড়ক আদৌ শৈব বা হিন্দু উৎসব নয়

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে, মহাদেব। টেনে টেনে সুর করে বাংলার প্রান্তিক স্তরের অচ্ছুৎ বাঙালির লৌকিক উৎসব গাজন। একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। রাজ্যের বিজেপি , তৃণমুল রামনবমী পালনে যত উৎসাহ তার সামান্যতম উৎসাহ দেখা যায় না গাজন বা চড়ক উৎসবে। বাংলার অন্যতম প্রাচীন লৌকিক ধর্মীয় উৎসব গাজন ও চড়ক মূলত রাঢ়বঙ্গের জেলাগুলিতে অনুষ্ঠিত হয়। বর্ধমানের কুড়মুন, উদ্ধারণপুর, বেগুনকোলা, শাঁখারি শিল্প্যা, গোপালপুর, দাঁইহাট, পাচুন্দির গাজন ও চড়ক আজও ঐতিহ্যগত প্রথা বহন করে চলেছে। পুরুলিয়ার প্রবাদ, গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লেই নাকি সজনে ডাঁটা ফাটতে শুরু করে। পুরুলিয়াকে তো শৈবক্ষেত্রও বলা হয়। বুধপুরের বুদ্ধেশ্বর , চিড় করির গৌরীনাথ, আনাড়ার বাণেশ্বর, তেলকুপির গদাধর। তেলকুপির অস্তিত্ব এখন নেই। পাঞ্চেত জলাধার নির্মাণে সেই গ্রাম অবলুপ্ত। ভূমিপুত্র বাঙালি ধর্ম ঠাকুরের রূপ দেন বুদ্ধদেবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। বৌদ্ধ ধর্মের নানা কারণে অবলুপ্তির পর শৈবের উপাসনা শুরু।চৈত্রমাস জুড়ে নতুন বস্ত্র গামছা পড়ে সারাদিন ঘুরে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ। সন্ধ্যায় মাটির মালসায় সেই অন্ন দিয়ে হবিষান্ন গ্রহণ। ভূমিতে শয়ন। কৃচ্ছসাধন। সংক্রান্তির ভোরে হাতা বাণ কোমরে বিঁধে পুরোহিতের মন্ত্রে অচেতন হন চড়ক সন্ন্যাসী। বাজে ঢাক।প্রাচীন লোকগান গাওয়া হয় শিব ব্যাটা বোয়ো, বউয়ের পাতে ভাত খেয়েছে, পেট করেছে লেও। জ্ঞান ফিরলে জিভে বাণ। শর শয্যার মত কাঁটা পেরেকের ওপর শোয়া।

বাঁকুড়ায় গাজন সন্ন্যাসী

বর্ধমান, পুরুলিয়া হাওড়া শুধু নয়, হুগলির তারকেশ্বর, নরসিংহবাটি, খানাকুলের ঘনটেশ্বর সোনাই চন্ডিপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজার , জয়রামপুর,বজবজের বুইটা, ক্যানিংয়ের মঠের দিঘি, জয়নগরের বাকসাড়া, কুলতলির সোনাঠিকা, মগরাহাটের শেরপুর, কসবা রথতলা, নদীয়ার তাঁতিপাড়ার দোলবাড়ি, চাকদহের বালিয়া, রানাঘাটের মাটি কুমড়া ইত্যাদি জায়গায় ব্রাত্যজনের গাজন ও চড়ক আজও ঐতিহ্য ।বাঁকুড়ার অনেক জায়গায় ভূমিপুত্র ব্রাত্যজনেরা এই উৎসবে মাতেন। উত্তর কলকাতার ছাতুবাবু বাজারে আজও চড়ক চলছে। ঐতিহাসিক তথ্য বলে মেদিনীপুর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি গাজন ও চড়ক হয়। শিবই যে বুদ্ধ থেকে রূপান্তরিত সেকথা লিখতে গিয়ে ড: আর এম দেবনাথের বঙ্গীয় ধর্মীয় সমাজ ও ইতিহাস ও বিবর্তন গ্রন্থে ড,: বারিদ বরণ ঘোষ ৮৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন মহাদেব ও বুদ্ধের তুলনামূলক বিচার করা হলে দেখা যায় শিব ও বুদ্ধের মধ্যে প্রচুর মিল। এঁরা কখনও সমান্তরাল ভাবে পূজিত হচ্ছেন, আবার কখনও একজন আর একজনের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন।ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, বুদ্ধ ও শিবের মূর্তি অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে বাংলার জনগণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য ছিল।

        আমরা জানি, দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে আর্যদের তুমুল সংঘাত ঘটে। এই সংঘাতের পরিণামেই বৌদ্ধ ধর্মের শক্তি বাড়ে। প্রতিপত্তিতে শিবের স্থান দখল করেন বুদ্ধ। হিন্দু ধর্মের প্রভাব এরপর যত বাড়তে থাকে বুদ্ধের স্থান ভূমিপুত্রদের কাছে লুপ্ত হয়ে স্থান দখল করেন শিব।ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থের আদি পর্বে ৩০০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও আমরা ধর্ম ঠাকুরকে বৌদ্ধ ধর্মের ধর্ম বলিয়া মনে করিতাম। কিন্তু সম্প্রতি নানা গবেষণার ফলে আমরা জানিয়াছি, ধর্ম ঠাকুর ছিলেন প্রাক আর্য আদিবাসীর শেষের দেবতা। ধর্ম ঠাকুরের আসল প্রতীক পাদুকা চিহ্ন ধর্ম পূজার পুরোহিতেরা তাঁহাদের গলায় ঝুলাইয়া রাখেন এক খণ্ড পাদুকার মালা।আজও ধর্ম পূজার প্রধান অধিকারী ডোমেরা। যদিও এখন কৈবর্ত, শুঁড়ি, বাগদি, ধোপা প্রভৃতিদের ভিতরও ধর্ম পূজার পুরোহিত বিরল নয়। রাঢ়দেশেই ধর্ম পূজার প্রচলন ছিল বেশি। এখনও তাহাই। তবে এখন কোথাও কোথাও ধর্মীয় ঠাকুর শিব বা বিষ্ণুতে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছেন, সেখানে তিনি ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছাড়া অন্য কাহারও পূজা গ্রহণ করেন না। স্তূপীকৃত পিষ্টক আর প্রচুর মদ্য দিয়া ধর্ম ঠাকুরের পূজা হইত।মৃতদেহ ও নরমুন্ড লইয়া ছিল ধর্মের গাজনের নাচ।

বিজ্ঞাপন

এই ধর্ম পুজোই যে নীল বা চড়ক, গাজন সে কথাও বলেছেন ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়। তিনি বলেছেন, ধর্ম পূজা সম্বন্ধে যাহা সত্য নীল বা চড়ক পূজা সম্বন্ধেও তাই। এই চড়ক পূজা এখন শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িত। অস্বীকার করার উপায় নেই বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার ধ্বজা প্রতিষ্ঠা করতে বুদ্ধ কে সরিয়ে শিবকে প্রতিষ্ঠা করা অনেক বেশি নিরাপদ ভেবেই বাংলার শিব চতুর্দশী ও চৈত্র সংক্রান্তির গাজনকে মেনে নিলেও বর্ণ হিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি শিব চতুর্দশী উৎসবে ধর্মীয় রীতনীতি মেনে শিব পার্বতীর পুজো করলেও গাজন বা চড়ক অন্ত্যজ শ্রেণীর উৎসব বলে নিজেরা যোগ দেন না।শিবের এই চৈত্র সংক্রান্তি ও গাজন ব্রাত্য জনের ব্রত হিসেবেই থেকে গেছে। ব্রাত্য শব্দটির সৃষ্টিও ব্রত থেকেই এসেছে। গ্রাম বাংলার মেয়েরা আজও কিছু ব্রত পালন করলেও শহুরে উচ্চবর্ণের মানুষ শুধু শিবরাত্রিটুকু স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাজ্য সরকার হিন্দু উৎসব, মুসলিম উৎসব খ্রিস্টান, শিখ, জৈন ,বা বৌদ্ধ উৎসবকে স্বীকৃতি দিলেও বাঙালির নিজস্ব উৎসব গাজন ও চড়ককে স্বীকৃতি দেন না। সম্ভবত বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা বা উচ্চ বর্ণের প্রভাব বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

ইতিহাসবিদরা বলেন, গাজন শব্দটি এসেছে গ্রাম জন গাঁয়ের জন শব্দ থেকে। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক স্থাপনে যে লৌকিক উৎসব ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পরিকল্পনায় সেটি হয়েছে শিবের সঙ্গে পার্বতীর পরজন্মে যিনি নীলাবতী হয়ে জন্মান তাঁদের বিয়ের দিন। সূর্যের প্রখরতা এখানে পৌরুষ আর নীলাবতী স্নিগ্ধতা। পুরাণ বলছে, রাজা বাণ জাতীয় ঐক্য গড়তে চড়ক উৎসবের সূচনা করেন। রাজা বাণ ছিলেন দৈত্যরাজ বলির ( অনার্য) শত পুত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তিনি মহাদেবকে তুষ্ট করেন কঠোর তপস্যা। মহাদেবের বরে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন শোণিতপুরে। শোণিতপুর বর্তমান অসমের গুয়াহাটি থেকে কমবেশি ২৫০ কিলোমিটার। কৃষ্ণ ভক্ত প্রহ্লাদ ছিলেন বাণ এর প্রপিতামহ। শিবভক্ত বাণ ছিলেন নারায়ণ বিরোধী। বাণকন্যা উষা কৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রেমে পড়ে সবার অজ্ঞাতে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেন।

                 রাজা বাণ খবর পেয়ে অনিরুদ্ধ ও তাঁর সেনাদের বন্দী করেন। কৃষ্ণ বাণকে পরাজিত করে পৌত্রকে মুক্ত করেন। এই পরাজয়ের বিরূদ্ধে অন্ত্যজরক্ষার শপথ নিয়েই চড়ক প্রথার সৃষ্টি করেন। এভাবেই হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা চড়কে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রত গ্রন্থে বলেছেন কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান তাই ব্রত। ব্রত মূলত দুইপ্রকার। শাস্ত্রীয় ( পৌরাণিক) ও অশাস্ত্রীয়। লৌকিক ব্রত কিছু আছে উভয়ের। চড়কের ব্রতে উপবাস নারী পুরুষ উভয়েই করে থাকেন। বাংলার ভূমিপুত্ররা একসময় ছিলেন বৌদ্ধ। হিন্দু নয়। এটা জানা দরকার। যে সংস্কার আজও চলছে। লৌকিক দেবতা ধর্ম ঠাকুরের মধ্য থেকে বৌদ্ধিক ভূত তাড়াতে শিবকে মেনে নেওয়া অনেক বেশি নিরাপদ। বৈদিক ছদ্মবেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আধিপত্য বজায় রাখতে বছরের দুটি দিন শিব চতুর্দশী আর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনকে প্রশ্রয় তো একটু দিতেই হয়। তাই বোধহয় গাজনের সন্ন্যাস ব্রত নিতে দেখা যায় না উচ্চবর্ণের মানুষদের।

বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *