সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : গত ৯ টি পর্বে সি এ এ সম্পর্কে যে ঝাপসা ধারণা বাংলার মানুষদের ছিল চেষ্টা করেছি সেই সব সঠিক তথ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা।শেষ পর্বে বলব বন্দী মুক্তি কমিটির একটি বই কোনও মানুষই বেআইনি নয় রায় পৃথিবীতে সুজাত ভদ্রের বক্তব্য। তিনি লিখেছেন, অ্যামেরিকা, ফ্রান্স সহ একাধিক দেশের মতো ভারতের সংবিধানেও নাগরিকত্বের সংজ্ঞা নেই। কিন্তু সংবিধানের নানা অনুচ্ছেদে (১-১১) নাগরিকের পরিচয় নিয়ে নানা সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। এমনকী ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইন রচিত হওয়ার আগেই ভোটের কার্ডকে নাগরিকের পরিচয় হিসেবে ভারতের সংসদ আইন করে স্বীকার করে নিয়েছিল। প্রমাণ?
১৯৫০ সালের ১২ মে সংসদে গৃহীত The representation of the people act ( জন প্রতিনিধিত্ব আইন) – এর ১৬ নং ধারাতে বলা আছে ভারতের নাগরিক না হলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ যাবে। অর্থাৎ ভোটার তালিকায় নাম থাকলে তিনি সংসদের আজ পর্যন্ত উক্ত অপরিবর্তিত আইন অনুসারে ভারতের নাগরিক। সুজাত ভদ্র আরও লিখেছেন, ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থে নীরজা গোপাল জয়াল, অনুপমা রায়, রাজীব ভার্গব দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র ভোটার কার্ড নয়, ভারতের নাগরিকত্বের পরিচয়ের প্রমাণ হিসাবে আরও কিছু marker বা চিন্হ আছে; বি পি এল কার্ড ( একেবারে তৃণমূল স্তরের গরীব মানুষের পরিচয় বহন করে) , ই পি এল , ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট এবং সর্বোপরি বিতর্কিত আধার কার্ড। তাহলে আবার নাগরিকের পরিচয় চাওয়া কেন,? নতুন করে নাগরিক পঞ্জীর পরিকল্পনা কেন? বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন,২০০৩ সালের সংশোধনী নাগরিকত্বের ধারণাকেই বদলে দিল।নরমপন্থী সকলের প্রিয় বাজপেয়ী ও তাঁর পরিচালিত সরকার এই বিপজ্জনক পরিবর্তনটি প্রায় বিনা বাধায় পাশ করিয়ে নিলেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ পরিষ্কারভাবে বলেছে, সংবিধান চালু হওয়ার সময় থেকে যে মানুষ ( person) ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন, অথবা তার মা অথবা বাবা এই দেশে জন্মেছেন বা যিনি সংবিধান চালু হওয়ার আগের ৫ বছর ধরে ভারতে রয়েছেন। জায়াল বলেছেন, এই অনুচ্ছেদই ভারতের সংবিধানের jus soli ( অর্থাৎ জন্মস্থানগত নাগরিকত্বের অধিকার ) – র ভিত্তিভূমি। এটা বেছে নেওয়া হয়েছিল কেন? কেন রক্তের সম্পর্কে – র ভিত্তিতে নাগরিকত্বের ( jus sanguinis) ধারণা প্রত্যাঘাত হয়েছিল?
সংবিধানের এই সংশোধনী কেন এত আগ্রাসী ও আক্রমণাত্বক সেই সম্পর্কে সুজাত ভদ্র বলেছেন, মোদী সরকারি এই নিজেদের ইচ্ছে পূরণের সাহস তৈরি হয়েছে ১) সংসদে ৩০৩ এর ক্ষমতা ২) তাদের ২০১৪ সাল থেকে অপদার্থ প্রশাসন চালানোর ব্যাপারটা এত নগ্ন ভাবে ফুটে উঠেছে, তার থেকে বিক্ষোভ যাতে না বাড়ে তার জন্য অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া , সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ , প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া। সি এ এ বা এন আর সি যে বিজেপি কয়েকবছর ধরে পরিকল্পনা করেছে ভাবলে ভুল হবে। সুজাত ভদ্র বলেছেন বর্তমান সংবিধানকে আমূল পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় জনসংঘ দলের। যেমন ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে ইশতেহারে জনসংঘ লিখেছিল ,Janasangha will amend the Constitution and declare Bharat to be a Unitary State” ( Bharatiya Janasangha Party documents 1951-1972(Delhi,1973),p82)
শুভেন্দু অধিকারী ও শান্তুনু ঠাকুর শুধু নন,দিল্লির নেতারাও বলেছেন সি এ তে যেসব হিন্দুর নাম বাদ যাবে তাঁদের সি এ এ দিয়েই ঢুকিয়ে নেওয়া হবে।রায় কথার কি কোনো ভিত্তি আছে?
বিরোধী পক্ষ মোক্ষম এক যুক্তি দিয়ে এই বক্তব্য খন্ডন করেছেন। তাঁরা বলছেন যদি কোনো হিন্দু এন পি আর এ নিজের নাগরিকত্ব ঘোষণা ভারতীয় হিসেবে করলে তারপর এনআর সি তে নাম তোলার জন্য কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করলেও নাম উঠবে না। এক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে আবেদনকারী বাংলাদেশ, পাকিস্থান বা আফগানিস্থান থেকে এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন, অর্থাৎ তিনি ভারতীয় নন। প্রথমে নিজেকে নাগরিক হিসেবে দাবি তারপর প্রমাণ না করতে পারায় দাবি দাঁড়াবে তিনি অন্য দেশের নাগরিক।দুবার দুটি বিরোধী দাবি জানানোয় নাগরিকত্ব তো মিলবেই না বরং তার নামে মিথ্যে তথ্য দেওয়ার জন্য মামলা হবে। ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য যদি আবেদনকারী ভারতে এসেও থাকেন, তাহলেই কি নাগরিকত্ব মিলবে? না এত সোজা নয় । সি এ এ অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ এর আগে এলে এবং ৫ বছর ভারতে বসবাস করলে ভারতের জন্য আবেদন করার সুযোগটুকু মিলবে।
মোদ্দা কথাটা দাঁড়ালো নিয়ম মেনে সি এ এ র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে প্রমাণ করতে হবে আবেদনকারী অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছেড়েছেন। কি দিয়ে প্রমাণ হবে তিনি কেন দেশ ছেড়ে ভারতে এসেছেন? তখন আবার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তাই যাঁরা ভাবছেন বাংলাদেশ, পাকিস্থান বা আফগানিস্থান থেকে আসা মুসলিমরাই শুধু বিপদে পড়বেন তা নয়। মনে রাখা দরকার, সংবিধানের ১৪ নম্বর ও ২১ নম্বর ধারায় পার্সন ( person) শব্দ আছে, নাগরিক ( citizen) শব্দটা নেই । তাহলে নাগরিকত্বহীন মানুষদের কি হবে? এঁদের স্থান হবে ডিটেকশন ক্যাম্পে। অসমে যা হচ্ছে। দিবেলা দুটো খাবারের জন্য বৃহৎ পুঁজিপতিদের কারখানায় সস্তার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হবে। সোজাকথায় নতুন ধরণেদাস প্রথার শিকার হবেন। বিপুল মুনাফার জন্য সস্তার দাস শ্রমিক এঁরাই হবেন। আজ যা অসমে হচ্ছে কাল পশ্চিমবঙ্গে তাই হবে। এই কাজ সোজা হবে ২০২৪ e যদি বিজেপি কেন্দ্রে ও রাজ্যে শক্তিশালী হবে। জনগণের একার কিছু করার নেই।একমাত্র বিরোধী দলগুলি যদি নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ হয তবেই মানুষ বাঁচবে। কিন্তু সেটা হবে কি? ৪ জুন নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বোঝা জানে বাঙালির ভবিষ্যত কি।
আজ রবিবার ২১ এপ্রিল।২০২৪। দৈনিক বর্তমান বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় পত্রিকার বারাসতের সাংবাদিক শ্যামলেন্দু গোস্বামী লিখেছেন , নাগরিকত্বের জন্য তাঁর দেওয়া কার্ড নাকি বিশেষ সুবিধা দেবে। বনগাঁর বিদায়ী সাংসদ শান্তুনু ঠাকুরের এই দাবির পরই বিজেপি প্রভাবিত অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সেই কার্ড সংগ্রহের প্রবণতা বেড়েছিল।তাৎপর্য কিন্তু সি এ অধীনে নাগরিকত্বের আবেদন করা নিয়ে মতুয়াদের সংশয় কাটেনি। ধন্দ আরও বাড়িয়েছিল জাতীয় স্তরে বিজেপি প্রকাশিত ইস্তাহারে নাগরিকত্বের সুলুক সন্ধান না থাকা। সেই বিভ্রান্তিকেই বদ্ধমূল করল স্থানীয় স্তরে বনগাঁ লোকসভার বিজেপি প্রার্থী শান্তুনু ঠাকুরের প্রচারপত্র। সেখানেও উধাও নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ। ফলে সি এ এ যে আসলে বিজেপির নির্বাচনী খুড়োর কল তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন মতুয়াদের একটা বড় অংশ।এম পি হিসেবে শান্তনু ঠাকুর তাঁর কাজের যে খতিয়ান পেশ করেছেন সেখানে নেই সি এ এ প্রসঙ্গ। মতুয়া মহাসংহের নতুন সদস্য কার্ডের জন্য নেওয়া হচ্ছে ৮৫ টাকা। আর ওই কার্ড নবীকরণে এক বছরের জন্য দিয়ে হচ্ছে ৫০ টাকা। এই কার্ড থাকলেই নাগরিকত্বের দাবিদার হওয়া যাবে এমন প্রচার চালাচ্ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সন্তান ও বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর। তিনি একথাও বলেছিলেন তৃণমূল সমর্থকদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। আজ রবিবার আর এক বাংলা দৈনিক প্রতিদিন পত্রিকায় সাময়িকী পৃষ্ঠায় স্যমন্তক ঘোষ লিখেছেন অসমে এন আর সি হয়েছে। ১৯ লখ মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ গিয়েছে। কেউ অ- নাগরিক, কেউ বে -নাগরিক, কেউ আধা নাগরিক,কেউ সোয়া নাগরিক।কেউ জানেনই না তিনি আদৌ নাগরিক কি না । দুই বাংলার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন।দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন গুজরাটের নাগরিকদের কাছে প্রমাণ দিতে হবে আমরা বাংলা তথা ভারতের নাগরিক কি না? মনে পড়ছে সুকুমার রায়ের সেই ছড়া। কবির কাছে মার্জনা চেয়ে বলাই যায়, এস এস বুথে এস ভোট দিয়ে যাও পদ্মেতে, আদর করে রাখব তোমায় নিরাপত্তার খোপেতে। হাতে আমার রাজদণ্ড , তাই কি কাছে আসছ না? দণ্ড আমার হালকা এমন মারলে তোমার লাগবে না। অভয় দিচ্ছি শুনছো না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা? ঘাড়ে যখন চাপবে ইডি বুঝবে তখন কাণ্ডটা। আমি আছি , অমিত আছে আছে ভক্ত হনুমান, সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে যদি ভয় পান।