পর্ব ৩
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ১৯৯৭। ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর। দেশে তখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব চলছে। এই তিনদিন কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অনুষ্ঠিত হল ভারতের যৌনকর্মীদের প্রথম জাতীয় সম্মেলন। বহু দেশি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক , প্রতিনিধি , মন্ত্রী ও অতিথি অভ্যাগতদের উপস্থিতিতে দাবি তোলা হল, গতর খাটিয়ে খাই। শ্রমিকের অধিকার চাই। এই কমিটি আগেই দাবি তুলেছিল সমাজসেবী হিসেবে স্বীকৃতি, ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। প্রিভেনশন অব ইম্মরাল ট্রাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ বাতিল করে গণিকাবৃত্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া। এঁদের যুক্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই পেশা চলমান, এই পেশার মেয়েরা কামুক পুরুষদের লালসা পূরণ করে সমাজের মেয়েদের রক্ষা করে থাকে ।
বিষয়টি সম্পর্কে বীনা চৌধুরী আমরা যুক্তিবাদী পত্রিকায় যৌনকর্মীদের দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত? প্রতিবেদনে লিখেছেন পুরুষ তার ভোগ লালসাকে চরিতার্থ করার জন্যই নারীকে শুচিতা ও সতীত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করে। আবার এই পুরুষই তার ভোগ লালসার নিবৃত্তির জন্য নারীকে শুচিতা ও সতীত্বের দোহাই দিয়ে ধর্ষিতা নারীকে করে সমাজচ্যুত করা হয় পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার উদ্দেশ্যে। কারণ পুরুষের বহুগামিতা সমাজ স্বীকৃত। আর নারীর ভাগ্যে জোটে চরম লাঞ্ছনা, অসম্মান, অপমান ও ধিক্কার। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নির্ভরশীল রাষ্ট্র এই অপমানিত, লাঞ্ছিত নারীর কোনো নিরাপত্তা বা দায়িত্ব নিতে পারেনা। উপরন্তু এই চরম অবমাননাকর বৃত্তিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আইনি স্বীকৃতি দিতে নানারকম যুক্তি হাজির করে। আর এই ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে এই সমাজচ্যুত নারীদের রেডলাইট এরিয়া বা ওই জাতীয় কোনো স্থানে নিক্ষেপ করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় ।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নির্ভরশীল রাষ্ট্র কখনই সমগ্র মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে না। আর তার ফলেই ধর্ষিতা না হয়েও অনেক নারী খিদের জ্বালায এই পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্র তার নিজের দায়িত্ব এড়াবার জন্য বা পরবর্তীতে PITA র মত আইন তৈরি করে নারীদের উন্নয়নের (?) পথ সুগম করে দেয়।রাষ্ট্রের এই আইনি স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে কখনই গণিকাবৃত্তির রদকরণ বা উচ্ছেদসাধন নয়। বরং এই বৃত্তি যাতে টিকে থাকে সেই ব্যবস্থা করি দেওয়াই এই আইনের উদ্দেশ্য। এই বৃত্তি আইনের চোখে অপরাধ নয়। (বর্ষ ১, দ্বিতীয় সংখ্যা,fenriari- এপ্রিল,১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১২,১৩)
রাষ্ট্রের এই পলায়নী মনোবৃত্তি আজকের নয়, বরাবরের। পিছিয়ে যেতে হবে প্রাচীন যুগে। বৈদিক যুগে আর্যগোষ্ঠীদের পুরুষদের ছিল প্রধান দেবতা ব্রহ্মা। উষা ছিলেন প্রজাপতি দক্ষের কন্যা। উষার রূপে কামাসক্ত হয়ে মিলিত হন। দুজনেই সেইসময় মৃগরূপ ধারণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র গৌতম ঋষির স্ত্রী অহল্যাতে উপগত হন। স্বয়ং বিষ্ণু অনার্য জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা ও শঙ্খচূড় অসুরের স্ত্রী তুলসিকে স্বামীর ছদ্মবেশে প্রতারিত করে যৌন মিলনে লালসা পরিপূর্ণ করেন। সপ্তর্ষিদের সাত স্ত্রী – কলা , অনুসুয়া, ক্ষমা, হবির্ভু, সন্নতি, শ্রদ্ধা ও অরুন্ধতীকে কামার্ত হয়ে ভোগ করেন অগ্নি। চন্দ্র দক্ষের ২৭ কন্যাকে বিয়ে করেই ক্ষান্ত নন,৬০ কোটি অপ্সরাকে নিয়ে মেতে থাকতেন। এমনকি দেবগুরু বৃহস্পতি যিনি চন্দ্রেরও শিক্ষাগুরু তাঁর স্ত্রী তারাকেও বিছানায় সঙ্গে করেন। তাঁদের অবৈধ সন্তান বুধের জন্ম হয়।
যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রয়াত প্রবীর ঘোষ তাঁর অলৌকিক নয় লৌকিক গ্রন্থে পঞ্চম খণ্ডে (প্রকাশক দে’জ) ১৭৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন পদ্মপুরান অনুসারে (৫/৩২/১৪) শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সংখ্যা ১৬ হাজার ১০০। এরা সকলেই গোপীবালা ছিলেন না। নান দেশ থেকে এইসব সুন্দরীদের অপহরণ করেএনে নিজের হারেমে পুরেছিলেন। এই প্রতিটি সুন্দরীর যৌবনই তিনি ভোগ করতেন,,,,,, পান থেকে চুন খসলে মুনি ঋষিরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে শাপ দিতেন। শাপের হাত থেকে বাঁচতে ঋষিদের শয্য্যা সঙ্গিনী হতে বাধ্য হতেন। অনেক ঋষি নিঃসন্তান রাজাদের রানীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতেন। যাকে সেযুগে বলা হত গুরুপ্রসাদী। আজও গোপনে গুরুপ্রসাদী প্রথা আছে। সেযুগে সুন্দরী অপ্সরাদের দেখলেই ঋষিদের রেত:পাত হয়ে যেত। রাষ্ট্রীয় মদত না থাকলে কি সম্ভব হত?
বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ববিদ ড: অতুল সুর দেবলোকে যৌন জীবন গ্রন্থে প্রথম সংস্করণে ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল। যৌনতা যে আর্য সমাজে জলভাত ছিল তার প্রমাণ রামায়ণ মহাভারতেও আছে।
বিজ্ঞাপন
রামায়ণের আদিকাণ্ডে পবনদেব রাজর্ষি কুষ্নাভের একে রূপবতী কন্যাকে ধর্ষণ করতে যান। কন্যারা বাধা দিলে পবনদেব তাঁদের শরীরে প্রবেশ করে তাঁদের শরীর ভগ্ন করে দেন।হয়নি! হনুমানের পিতা কেশরীরাজ কিন্তু হনুমানের জন্মদাতা পিতা নন। রাণী অঞ্জনার গর্ভে হনুমানের জন্ম পবনদেবে ঔরসে। মহাভারতে আছে বরুণদেব চন্দ্রের কন্যা উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে ভর করেন দেবতাদের চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয় শর্যাতি রাজার মেয়ে সুন্দরী সুকন্যাকে স্নানে নগ্ন দেখে কামতাড়িত হন। জরাগ্রস্থ স্বামী ঋষি চ্যবনকে ছেড়ে চলে আসার জন্য পরস্ত্রীকে ফুসলাতে ছাড়েননি। তবে আর্য যুগে শুধু পুরুষ দেবতারা যৌনতা করতেন তা নয়। মেয়েরাও কম যেতেন না।দক্ষকন্যা স্বাহা কামনা করতেন সপ্তর্ষির স্ত্রীদের। স্বাহা তাই ছবার ঋষি পত্নীর ছদ্মবেশে অগ্নির পৌরুষত্বের স্বাদ নেন। শেষ পর্যন্ত অগ্নির স্ত্রী হয়ে দেবলোকে গিয়ে কৃষ্ণের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। বৈদিক সাহিত্যে ও বৌদ্ধ সাহিত্যে ভাইবোনের যৌনতার হাজার কাহিনী আছে। স্বয়ং ধর্মের প্রতীক যমও সুদর্শনের স্ত্রী ওঘাবতীকে ভোগ করেন। মেয়ে ঋতুমতী হলে বিবাহ দেওয়া হত মেয়েদের। প্রথম সতীত্বনাশের অধিকার ছিল কুল গুরুদেবের। যাকে বলা হয় গুরুপ্রসাদী। এই ধারা বিদেশেও ছিল। এই অবাধ যৌনতা যখন সমাজে বিশৃঙ্খলা এনে দিল , তখন যৌনতাকে একটা বাঁধন দেওয়া হল। বেশ্যাবৃত্তি জুড়ে যায় ধর্মের সঙ্গে।( চলবে)