বেশ্যার বারমাস্যা (পর্ব : ১)
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বেশ্যার বারমাস্যা শব্দে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে মুচকি হেসে বলবেন , অশ্লীল শব্দ জুড়ে পাঠককে আকর্ষণ করার এক ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা। কুছ লোগ তো কহেঙ্গে। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঁধন ছিঁড়ে নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা রুচি বোধে আটকায় ঠিকই, কিন্তু বাস্তব সত্যতটা তো অস্বীকার করা যায় না। দেহ ব্যবসা প্রাচীন পেশা সবাই জানে। কিন্তু সত্যিই কি আমরা যৌনকর্মীদের সম্পর্কে সব জানি? সমাজে , রাষ্ট্রে ধর্মে পুরাণে যৌনতার একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ভূমিকা আছে যৌনকর্মীদের। প্রাণী জগতে যৌনতা যদি গুরুত্বপূর্ণ না হত তাহলে বাৎস্যায়নের মত পণ্ডিত কামশাস্ত্র লিখতেন না। তবুও রক্ষণশীল পাঠকদের সম্মান জানিয়েই বেশ্যা শব্দের আভিধানিক অর্থ কী খুঁজলাম।
সংসদের অভিধান বলছে, বেশ্যা শব্দের অর্থ বারাঙ্গনা, গণিকা, দেহপজীবিনী। প্রতিশব্দগুলির মধ্যে একটা শ্লীলতা আছে। কিন্তু বেশ্যা? নৈব নৈব চ। অথচ প্রাচীন সমাজে বেশ্যা শব্দের অর্থ ছিল সাজসজ্জা দিয়ে পুরুষকে প্রলোভিত করে যে নারী তাঁকে বেশ্যা বলা হত। অর্থাৎ শৃঙ্গার রসে সিক্ত নারী পুরুষের আকর্ষণে সমর্থ হন তিনিই বেশ্যা । ঋকবেদে প্রথম মণ্ডলের ১২৬ নং সূক্তের পঞ্চম ঋকে আছে, সু বন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব, অন স্বত্ব শ্রব ঐযন্ত পূজা। ঐতিহাসিক ভিন্টারনিৎস্ বলেছেন, এই বিশ্যা শব্দ থেকেই বেশ্যা শব্দটির উৎপত্তি। বাৎস্যায়ন তাঁর কামশাস্ত্রে লিখেছেন, বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতি বৃত্তিশ্চ সর্গৎ। অর্থাৎ বেশ্যাদের পুরুষ গ্রহণ প্রবৃত্তি কিংবা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা ও অর্থ উপার্জন সৃষ্টির শুরু থেকেই। বেশ্যার আরেক নাম বারবণিতা। বারো জনের শয্য্যাসঙ্গিনী। অভিভাবকহীন নারী পথভ্রষ্টা, কুলটা।
ওয়েবস্টার অভিধান বলছে, সুমেরীয়দের মধ্যে প্রথম যৌনকর্মীর সৃষ্টি। ব্যাবিলনে প্রত্যেক নারীকে উর্বরতা, সৌন্দর্য ও যৌনতার দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত ও একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময় যৌন মিলন করা ছিল বাধ্যতামূলক। এই সংস্কৃতি সাইপ্রাস করিস্থ ঘুরে সার্ডিলিয়াও ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে মিশে যায়। এরপর গ্রিস, জাপানে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে। আরবে প্রচলিত ছিল পুরুষ নারী ও পশু মৈথুন। এমনটাই লিখে গেছেন মওলানা আক্রম খাঁ। যুগ পাল্টেছে। সমাজের সামাজিক নিয়ম নীতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন তো বটেই পরিমার্জনও ঘটেছে। ইতিহাস বলছে , প্রাথমিক যুগে মানুষ যখন না মানুষ থেকে প্রায় মানুষ পর্যায় অতিক্রম করে পূর্ণমানব হয়ে দলবদ্ধ হয়ে বাঁচতে শিখল তখন ছিল না কোনো সামাজিক পরিচয়। মা বাবা স্বামী স্ত্রী , ভাই বোন কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক নিয়মের শর্ত মেলে ছিল অবাধ যৌনতা। দলগত পুরুষের সঙ্গে দলগত নারীর যৌন সম্পর্ক। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে বিবর্তন ঘটেছে। বাড়তি উৎপাদন পরিণত হয়েছে ব্যক্তি সম্পত্তিতে। তৈরি হয়েছে নেতা। নেতা হয়েছে শাসক। শাসক হয়েছে শোষক।
শোষিত সৃষ্টি না হলে শাসকের অস্তিত্ব কি? সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই বিবাহ প্রথার সৃষ্টি। আপন ভাইবোন জ্ঞাতি মামাতো খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনের বিবাহ অর্থাৎ যৌথ বিবাহ প্রথা চালু হলো। পরবর্তী কালেও মহাভারতের পাতায় পেয়েছি পঞ্চপাণ্ডবের যৌথ স্ত্রী দ্রৌপদী। সেই প্রাথমিক যুগে না ছিল মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা b, না ছিল পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ব্যক্তি সম্পত্তির ব্যাপ্তি যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে শাসক ও শোষণের সংখ্যা। গোষ্ঠিপতির পাশে স্থান পায় পুরোহিত। বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে যেমন মৎস পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ কিম্বা ঐতেরেয ব্রাহ্মণের পাতায় পাতায় আছে রক্তের সম্পর্কে ভাইবোনের বিয়ে। ব্রহ্মপুরাণে ব্রহ্মা ও তাঁর কন্যা সরস্বতীর যৌনতার বিবরণ আছে। হরিবংশ পুরাণে আছে প্রজাপতির কন্যা শতরূপার সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বিবরণ। জহ্নু বিয়ে করেন সহোদরা জাহ্নবীকে। মনু বিয়ে করেন কন্যা ইলাকে। প্রচেতা নামে পরিচিত দশভাই মিলে জন্ম দেন একপুত্রের। পুত্রের নাম সোম। সোমের সঙ্গে যৌনতায় যুক্ত হন সোমের কন্যা মরিশা। দশ পিতামহও যৌনতায় যুক্ত হন পুত্রের সঙ্গিনী মরিশার সঙ্গে। দক্ষ প্রজাপতির এগারো পিতা সাতাশ কন্যার জনক হন। এই সাতাশ কন্যার সঙ্গেও যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন সোম।
ঐতেরয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, সোমের আপন বোন সীতা সাবিত্রী ( রামায়ণের চরিত্র নন,) চেয়েছিলেন দাদা সোমের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে। সোমের ইচ্ছে তাঁর আরেক বোন শ্রদ্ধার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কেননা সীতা সাবিত্রী বশীকরণ মন্ত্রে দাদাকে সম্মোহন করে তাঁকে শয্যাসঙ্গী করেন। এখানেই শেষ নয়। ঋগবেদে আছে দম্ভ নিজ বোন মায়াকে, লোভ নিজ বোন প্রবৃত্তিকে , ক্রোধ নিজ বোন হিংসাকে, কলি নিজ বোন নিরুক্তিকে বিয়ে করছে। মহাভারতে দেখেছি ইন্দ্রের শয্যাসঙ্গিনী অপ্সরা উর্বশী পুত্র অর্জুনকে কামনা করছেন। যমুনা আর যমকে নিয়ে ভাইফোঁটার ছড়া। সেই যমি দাদা যমকে চাইছেন শয্যাসঙ্গী হিসেবে। এখন যাঁরা শরীর সঁপে মানুষের যৌন খিদে মেটান আইনি পরিভাষায় তাঁরা পরিচিত হচ্ছেন যৌন কর্মী নামে। যৌনপল্লির আরেক নাম নিষিদ্ধ পল্লী। কিন্তু মানুষের নিষিদ্ধ শব্দের প্রতি সম্মোহিত আকর্ষণ শুরু থেকেই। তাই লোকনজর এড়িয়ে ধনী, দরিদ্র সমাজে ব্রাত্য বা প্রতিষ্ঠিত সব ধরণের মানুষের একাংশের যাতায়াত আছে যৌনপল্লীতে । মনে পড়ে নিশিপদ্ম ছবির সেই গান। ওরা যে যা খুশি বলে বলুক লোকে, ওদের কথায় কি আসে যায়, ওরাই রাতে ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু যে খায়।
যৌনপল্লীর জগৎ যেন এক আলাদা গ্রহ। সেখানে চোখের ভাষা আলাদা খুপড়ি খুপড়ি ঘরে সস্তার পণ্য নারীর ঠোঁটে সস্তার লিপ স্টিক , চড়া পাউডার, স্নোর প্রলেপে ফর্সা সাজার আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টা। ল্যাম্প পোস্ট বা বাড়ির দরজায় দেহের বিপদজনক খাঁজের পসরা সাজিয়ে যৌন কর্মীর নীরব আমন্ত্রণ। সেখানে চোখের ভাষা যেমন আলাদা, তেমন কথ্য ভাষাও আলাদা। এখানকার শব্দ ভান্ডারে আছে ফ্লাইং, নথতরণী, গ্রুপ সেক্স, আঁধিয়া , এঁটো, ভেরুয়া, বাবু, মাসী, খাউ, খদ্দের, খানেওলা, খিল্লি লেড়কা, চামচা, চিংড়ি, চ্যাংলা, ছুটকামাই, টেনিয়া, টাইম বাবু, ঠুনকা আরও কত।
বেশ্যার বারমাস্যা জানতে এই গ্রহের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা আগে দরকার। ফ্লাইং অর্থাৎ যাঁরা অনিয়মিত খদ্দের। মাঝে মাঝে আসে। নথতরণী অর্থাৎ যৌন পল্লীতে যে মেয়েটির প্রথম কৌমার্য বিসর্জন দিতে হবে তাঁর নাকে একটি নথ লাগানো হয়। তারপর খদ্দেরদের মাঝখানে দর হাঁকা হয়। যে সবচেয়ে বেশি টাকা দিতে রাজি হয়সে মেয়েটির নথ খোলে। বিষয়টা প্রতীকী। মাসী অর্থাৎ মেয়েটির অভিভাবক সেই খদ্দেরের হাতে মেয়েটিকে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।অভ্যস্ত খদ্দের বোকা নয় । মেয়েটি সত্যি কুমারী কিনা তাঁর পরীক্ষা নেয় বিছানা রক্তে ভিজছে কি না।না হলে পয়সা ফেরত মেলে.। তবে এই পর্বটি পুরানো খদ্দেরদের মধ্যেই হয়। সাধারণত ১৫/১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। মেয়েটি কোনো যৌনকর্মীরও হতে পারে। কিম্বা পাচার হয়ে আসা মেয়েও হতে পারে। গ্রুপ সেক্স। অর্থাৎ দুতিনজন মিলে একটি মেয়েকে নিয়ে যখন ফুর্তি করে। এক্ষেত্রে মেয়েটি দর বেশি হাঁকে।
নিষিদ্ধপল্লীতে আরও কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার হয়। যেমন আঁধিয়া অর্থ চটকদার মেয়ে। এঁটো অর্থাৎ চিংড়ি অর্থাৎ কমবয়সী সুন্দরী যৌনকর্মী, যে মেয়ে আগে রেপড হয়ে এই পেশায় এসেছে। ভেরুয়া অর্থাৎ যে মেয়ের একজন অভিভাবক পুরুষ থাকে। যে কোনো রোজগার করে না। ঘরে খদ্দের এলে বাচ্ছাদের নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। বাবু অর্থাৎ খদ্দের কিন্তু প্রায়ই আসে নিষিদ্ধ পল্লীতে। খাউ অর্থাৎ যে মেয়ে নিয়মিত যৌন কর্মী নয়। রাতেও যৌনপল্লীতে নাও থাকতে পারে। সমাজে থাকে। বাড়ির লোক কখনও জানে কখনও জানে না যে তাঁদের মেয়ে বা বৌমা চাকরি করতে যায় না , দেহ ব্যবসা করে। এঁদের অনেকে সংসারের আর্থিক সাচ্ছন্দের জন্য করেন এই কাজ। নয়ত নিজের শখ মেটাতে পয়সার সংস্থান করতে। খানেওলা। অর্থাৎ যে খদ্দের ভালো মেয়ের জন্য ভালো দাম দিতে পিছুপা হয় না।
খিল্লি লেড়কা অর্থাৎ যৌনপল্লীতে আসা নাবালক খদ্দের। চামচা অর্থাৎ খদ্দের ঘরে এলে মদ বা খাবার কিংবা খদ্দেরের পছন্দমত জিনিস এনে দেওয়ার লোক। সাধারণত নিষিদ্ধপল্লীর বেচাকেনা হয় সন্ধের পর। সকালে বা দুপুরে যদি কোনো খদ্দের অল্প সময়ের জন্য আসে তার দেওয়া টাকাকে ছুট কামাই বলে। রাস্তা থেকে যৌন কর্মীর পোষালোক যারা খদ্দের নিয়ে আসে তাদের টেনিয়া বলা হয়। টাইম বাবু তারাই যারা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আসে। ঠুনকা বলা হয় যারা কম জন্য সময়ের যৌনকর্মীর সঙ্গে চুক্তি করে। কিছু খদ্দের আছে যাঁরা কোনো যৌনকর্মীর সব খরচ চালায়। অন্য কোনো খদ্দের ঘরে আনা যায় না সেই সব বাঁধা মেয়েমানুষ কে কাৎলা বলে। দালাল যখন খদ্দেরকে মন পছন্দ যৌনকর্মীর ঘরে পৌঁছে দেয় তখন তারা যে দালালি পায় তাকে বলে চামা। বেশ্যাপল্লীতে যারা আসতে অভ্যস্ত তাদের পাগলিবাজি বলা হয়।
বেশ্যাপল্লীতে নতুন মেয়ে এলে তাকে বলা হয় নতুন পাখি। অল্পবয়সী যৌন কর্মীকে বলে চ্যাঙলা। এমন অনেক নাম। অনেক পরিচয়। শেষ থেকে শুরু করলেও ফিরে যাবো অতীতে। বৈদিক যুগে।তখনকার হতভাগ্য যৌনকর্মীদের বারমাস্যার বিবরণ নিয়ে। বৈদিক যুগ পেরিয়ে পুরাণের যুগ । পুরাণের যুগ থেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। সে এক যেন মহাকাব্য। ( চলবে)