শ্রীজিৎ চট্টরাজ : ২০২১। মে মাস। স্বঘোষিত যোগ গুরু ওরফে লালা থুড়ি বাবা রামদেব বলেছিলেন, এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা আসলে লোক ঠকানো কারবার। সেই চিকিৎসা নেওয়া বোকামি। চিকিৎসার নামে তামাশা চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ এই বাবাজির বক্তব্য অস্বস্তিতে পড়ে যান তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন । যিনি নিজেও একজন এ্যালোপ্যাথি ন্ডাক্তার। রামদেব বাবাকে ডেকে তিনি এই আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য চিকিৎসক সংগঠনের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। কেননা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন মূলত যা সর্বভারতীয় ডাক্তারদের সংগঠনের উত্তরাখণ্ড শাখা আদালতে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য রামদেব বাবার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করে। রামদেব বাবা শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা পাননি। বাধ্য হয়ে বেগতিক দেখে সেবার রামদেব বাবা ক্ষমা চান। তবে এও ধমকি দিয়েছিলেন, কারো বাপের ক্ষমতা নেই আমাকে গ্রেপ্তার করে। ঠিকই, হাজার বেআইনি কাজ করেও প্রশাসন রামদেব বাবাকে হাজতে পাঠাতে পারেনি কেউ। আগেও রামদেব বাবা এবং তাঁর ব্যবসায়িক সংস্থা পতঞ্জলি সংস্থা বহু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
মঙ্গলবার দেশের শীর্ষ আদালত আবার রামদেব বাবাকে তলব করেছে। সঙ্গে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আচার্য বালকৃষ্ণকেও তলব করা হয়েছে। এবারের অভিযোগ ,মিথ্যে বিজ্ঞাপনে রোগমুক্তির প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে রামদেব বাবা আদালত হাজিরার আদেশ অমান্য করেন। ফলে আদালত অবমাননা সংক্রান্ত একটি সমন জারি করে শীর্ষ আদালত নতুন সমন পাঠিয়ে কৈফিয়ৎ দাবি করে। সেই নোটিশের জবাব না মেলায ক্ষুব্ধ শীর্ষ আদালত। মঙ্গলবার বিচারপতি হিমা কোহলি ও বিচারপতি আহাসানউদ্দিন আমানুল্লার বেঞ্চ রামদেব বাবা ও বালকৃষ্ণকে সশরীরে শীর্ষ আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য গত বছরে নভেম্বর মাসে পতঞ্জলি ওষুধ নির্মাতা সংস্থাকে বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসেবে নিজেদের ওষুধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ও মিথ্যা প্রচার সম্পর্কে সতর্ক করেছিল শীর্ষ আদালত। জরিমানা করা হবে ভবিষ্যতে তাও মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছিল। শীর্ষ আদালত পাশাপশি কেন্দ্রীয় সরকারকে সমালোচনা করে বলেছিল, সরকার চোখ বন্ধ করে বসে। যেটা দুর্ভাগ্যজনক। রামদেব বাবার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ ছিল, পতঞ্জলি সংস্থা এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক কুৎসা করছে।
তাঁদের আরও অভিযোগ ছিল , বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে পতঞ্জলি। করোনা প্রতিষেধক হিসেবে করোনিল বিক্রি করে আড়াইশো কোটি টাকা মুনাফা করে। ২০২৩ সালের ১৩ জুন করোনা প্রবাহে প্রথমবার করোনিল কিট বাজারে আনে পতঞ্জলি। শ্বাসারি বটি নামে ২০ মিলিলিটারের একটি তেলের শিশির দাম রাখা হয় ৫৪৫ টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মানুষের আয়ুর্বেদের ওপর বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে ২৩ লক্ষ ৫৪ হাজার করোনিল কিট বিক্রির হিসেব পতঞ্জলিই দেয়। এবারের শীর্ষ আদালতের সমন কিভাবে রামদেব বাবা সামলান সেটা এখন দেখার।
২০২০ তে মাদ্রাজ হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করে চেন্নাইয়ের আরুদ্রা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড । এই সংস্থার অভিযোগ ছিল করোনিল ৯২ বি নামে তাঁদের একটি অ্যাসিড ইনহিভিটর রয়েছে যা শিল্প উৎপাদনের নানা কাজে লাগে। সেই নামের ট্রেডমার্ক তাঁদের নেওয়া আছে ১৯২৭ পর্যন্ত। কিন্তু রামদেব বাবা বেআইনি ভাবে সেই নাম দিয়ে নিজের পণ্য প্রচার ও বিক্রয় করেছেন । সেই মামলায় রামদেবের পতঞ্জলি সংস্থাকে কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়। সেই সময় বিস্ফোরক অভিযোগ করে এ্যালোপ্যাথি ডাক্তারদের সংগঠন। তাঁরা বলেন , করোনিল আসলে এ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ ককটেল। মিক্সোপ্যাথি। এই অভিযোগের পর রামদেব বাবা ১৮০ ডিগ্রি ডিগবাজি খেয়ে বলেছিলেন, করোনিল করোনা প্রতিষেধক নয়, ইমিউনিটি বাড়ানোর ওষুধ।
একবার এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলে মুখোমুখি হয়েছিলেন এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক রাহুল ভার্গব এবং পতঞ্জলির অন্যতম কর্তা আচার্য বালকৃষ্ণ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, করোনিল করোনার ওষুধ হিসেবে ট্রায়ালের কোনো রিপোর্ট নেই। তবু বাজারে ছাড়া হল। হুও ওষুধটি স্বীকৃতি দেয়নি। তবু কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হল। বিশিষ্ট চিকিৎসক ও এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতা ডা: জয়েশ লেলে বলেন, করোনা সময়ে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকেরা জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা করছিলেন , বাড়ি থাকলে খাওয়ার অভাব হত না। তবু তাঁরা বাড়ি বসে থাকেননি। বরং বহু ডাক্তার মারা গেছেন। করোনিল যদি সত্যিই ওষুধ হত, কিম্বা যোগ দিয়ে মানুষকে সুস্থ করা যেত তাহলে কেন পতঞ্জলির ভাইস প্রেসিডেন্ট করোনাতে মারা গেলেন? কেন করোনাতে পতঞ্জলির প্রায় ৮০ জন কর্মী আক্রান্ত হলেন ? এবার শীর্ষ আদালত অবমাননার সমন পেয়ে রামদেব বাবা ও তাঁর ব্যবসায়িক সিং বালকৃষ্ণ কি করেন সেটাই এখন দেখার।