করোনা সময়কাল। হঠাৎ একদিন সকালে ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধু কুণাল ঘোষের ফোন। কুশল বিনিময়ের পর কুণাল জানালো বাড়িতে যখন বন্দী।, তখন একটা গবেষণামূলক লেখা লিখুন। আমি ই বুকে প্রকাশ করব। বিষয়টি সেই নির্বাচন করে দিল। বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাস। শুনেই চমকে উঠেছিলাম। কাকে দিচ্ছ রাজার পার্ট। আমি সামান্য এক ক্ষুদ্র সাংবাদিক। এই বিশাল ব্যাপ্তির কাজে হাত দেওয়া মানে সাপের গর্তে হাত ঢোকানো। তবু অনড় কুণাল। ওঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার হাজার যোজন দূরের সস্পর্ক। কিন্তু কলকাতায় যখন কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব ছিল না তখন কলকাতা দূরদর্শনে বেসরকারি প্রযোজনায় সংবাদ ম্যাগাজিন তৈরির দুঃসাহস তো দেখিয়েছিলাম কুণালের মত তৎপর সাংবাদিককে পাশে পেয়েছিলাম বলে। বাংলার টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যদি পত্তন করতে পারি সাফল্যের সঙ্গে, তবে এই কাজটাও পারব ।। সবচেয়ে বড় কথা,, এই লেখায় আমার কৃতিত্ব নেই। আমার কাজ তো তথ্য সংগ্রহ করে মালা গাঁথা। করোনা প্রবাহে শুরু করেছিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম বাংলার ঐতিহাসিকদের বহুলাংশই উচ্চবর্ণের মানুষ। ফলে ভূমিপূত্র বাঙ্গালির ইতিহাস, সংস্কৃতি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই আমার তথ্য খোঁজার কাজটা হলো গোয়েন্দার সূত্র খোঁজার মত।
সেই খুঁজে পাওয়া তথ্য যদি বাঙালির কোনো কাজে লাগে সেই আশায় পর্ব অনুযায়ী পরিবেশন করতে চলেছি। শুধু প্রশংসা নয়,সমালোচনাও চাই। তবে তো নিজের ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধন করত পারবো। বিষয়টি যেহেতু কুণাল ঘোষের অনুপ্রেরণায় তাই লেখাটি তাঁকেই উৎসর্গ করছি।
পর্ব: ১৮
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বাংলায় মুসলিম রাজার আগমন প্রসঙ্গে জহিরুল হাসান এর ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’ (প্রকাশক: পূর্বা,কলকাতা) গ্রন্থে ২৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, সেনবংশকে উৎখাত করে বাংলায় মুসলিম শাসন যিনি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর পুরো নাম ইখতিয়াররুদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি। কেউ কেউ বখতিয়ার _এর বিন শব্দটিও আমদানি করতে চান। বিন থাকলে নামের মানে দাঁড়াবে বখতিয়ার খলজি র পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী তবাকত- ই – নাসিরির অনুবাদক মেজর এইচ জি রেভার্টি। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের অগ্রগণ্য ঐতিহাসিকরা বখতিয়ারের নামে বিন বর্জনেরই পক্ষপাতী। খলজি তাঁর পদবি ও গোষ্ঠী পরিচয়। জাতিতে যদিও তুর্কি , জন্ম আফগানিস্থানে। হঠাৎ রাতারাতি লক্ষণসেনের দুয়ারে এসে উপস্থিত হননি তিনি। বিহার আগেই দখল করে নিয়েছিলেন। মাত্র আঠেরোজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে তাঁর নদীয়াবিজয় অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কেউ কেউ একে অতিকথা বলে উড়িয়ে দিতে চান। বাস্তবে তাঁর সৈন্যবাহিনী এত ক্ষুদ্র ছিল না।
মোহাম্মদ ঘোরির কাছে প্রথম জীবনে সৈনিকের চাকরি করতেন বখতিয়ার খিলজি ।
বাংলায় মুসলিম নবাবের অনুপ্রবেশ ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে হলেও ভারতে ইসলামী শাসন শুরু হয়ে যায় ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম ইসলামিক শাসকের নাম বখতিয়ার খিলজি। যাঁর জন্ম আফগানিস্থানের গরমশির গ্রামে।তিনি ছিলেন খিলজি উপজাতির সন্তান।জাতিতে তুর্কি। শৈশবের ইতিহাস তেমন জানা যায় না। তবে পরিবারে দারিদ্রতা ছিল নিত্য সঙ্গী। শোনা যায়,প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন স্বাধীন দস্যু। লুটপাটই ছিল তাঁর জীবিকা। একসময় জীবিকার সন্ধানে বখতিয়ার ভাগ্যান্বেষণে আফগানিস্থান ছেড়ে প্রথমে যান গজনির সুলতান মোহাম্মদ ঘোরির কাছে। উদ্দেশ্য, সেনাদলে যোগ দিয়ে জীবিকা নিশ্চিত করা। সে যুগে সেনাদলে নাম লেখানোর কিছু শর্ত ছিল। তা হলো, নিযুক্ত সেনার নিজস্ব ঘোড়া ও তলোয়ার থাকতে হবে। জীবন যাঁর দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে ,দুবেলা অন্নসংস্থান যাঁর কাছে বিলাসিতা, তাঁর পক্ষে ঘোড়া আর তলোয়ার জোগাড় করা তো স্বপ্ন। তাছাড়া চেহারাও ছিল না সৈনিকের মত।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খিলজি সত্যিই দায়ী কিনা তাই নিয়ে আছে বিতর্ক।
গজনি থেকে বিদায় নিয়ে বখতিয়ার চলে আসেন কুতুবুদ্দিন আইবেকের দরবারে। সেখানেও ব্যর্থ। পরবর্তী লক্ষ্য বদাউন। এখানে সুযোগ মিলল।সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবারুদ্দুইন খিলজিকে নগদ বেতনের বিনিময়ে সেনার চাকরি দেন। খিলজির ছিল অনেক বড় স্বপ্ন। সামান্য সেনার চাকরি তাই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সেনার চাকরি ছেড়ে খিলজি চলে যান অযোধ্যায়। অযোধ্যার শাসক ছিলেন হুসমুদ্দিন। তিনি বখতিয়ার খিলজিকে এখনকার মির্জাপুর জেলার ভগবৎ ও ভিউলি নামের দুটি পরগণার জায়গীরদার করেন।এখানেই বখতিয়ারের ভাগ্য খুলে যায়। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র দু হাজার সেনা নিয়ে বিহার রাজ্য জয় করেন। সেখানে ছিল কিছু বৌদ্ধ বিহার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিহারটি ছিল ওদন্তপুরী বিহার। খিলজি এই বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেন। ঐতিহাসিক সূত্র বলে, ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেন খিলজি। হত্যা করেন এখানকার বহু ছাত্রকে। মুসলিম ঐতিহাসিকেরা খিলজির দোষ স্খলন করতে বলেন, খিলজি ছিলেন অশিক্ষিত। তাই নালন্দা ধ্বংস করার সময় জানতেন না এটি শিক্ষালয়। তাঁর নাকি ধারণা ছিল সেটি একটি কেল্লা। উদ্দেশ্য ছিল, লুণ্ঠন করে ধনসম্পদ অধিকার করা। কেননা বিহার জয় করে প্রচুর সম্পদ নিয়ে গিয়ে অযোধ্যার শাসক হুসামুদ্দিনকে নজরানা দেন কৃতজ্ঞতা হেতু।
বিহার জয় আর প্রচুর ধন সম্পদ পেয়ে খিলজিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন অযোধ্যার শাসক। তিনি বুঝলেন,পাকা জহুরীর মত হীরে চিনতে তিনি ভুল করেননি। অল্পদিনেই বখতিয়ার খিলজির শৌর্য বীর্যের কথা ভারতময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
তবে ঐতিহাসিক সূত্র বলে,নালন্দা ধ্বংস যে প্রথম বখতিয়ার খিলজী করেন এমন নয়।প্রথমবার নালন্দা ধ্বংসের কারণ হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। পাল রাজাদের আমলে সোমপুর,বিক্রম শীলা ও নালন্দা ছিল একই প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত।বলা হয়, নালম দা শব্দ থেকে নালন্দা শব্দের উৎপত্তি। নালম শব্দের অর্থ পদ্মফুল। যা জ্ঞানের প্রতীক। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় বলা যায়না।খুব সম্ভবত ৪২৭ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি।পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণে বড়গাঁও গ্রামের পাশে। বিহার শব্দের অর্থ বিচরণ। বৌদ্ধ বিহার। অর্থাৎ বৌদ্ধদের বিচরণ কেন্দ্র।আকবর পাটনা মানে সেদিনের পাটলিপুত্র জয় করেন ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে। মোঘল জমানার শেষে ইংরেজের হাত থেকে সেদিনের বৃহৎ বঙ্গ অধিকার করে ইংরেজ। তারপর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বৃহৎ বঙ্গ থেকে বিহার উড়িষ্যা আলাদা করে।
ঐতিহাসিকদের একাংশের মত, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য দায়ী রাজা মিহিরাকুল ও শশাঙ্ক দায়ী।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজারা নালন্দা সংলগ্ন অঞ্চলে বহু মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুমার গুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি পূর্ণ বিকশিত হয়। হর্ষবর্ধনের এবং পাল রাজাদের আমলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। দশ হাজার ছাত্রের জন্য ছিল প্রায় দু হাজার শিক্ষক।রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে এই মহা বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মিলত।ইতিহাস বলে, বখতিয়ার খিলজির আগে স্কন্ধ গুপ্তের সময়ে (,৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) হুন রাজা মিহিরাকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হুন সেনারা প্রথম নালন্দা ধ্বংস করেন। দ্বিতীয়বার শশাঙ্ক হর্ষবর্ধনকে আক্রমণ করতে নালন্দা ধ্বংস করেন। তৃতীয়বার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে ইতিহাসে ধিকৃত হয়েছেন বখতিয়ার খিলজী।এমনটাই লিখেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডি এন ঝা তাঁর হাউ হিস্টরি ওয়াজ আন মেড অ্যাট নালন্দা (জুলাই ২০১৪)।
গৌড়ে লক্ষ্মণ সেনের দুর্গ
বাংলার ব্রাহ্মণদের মারফৎ বখতিয়ারের বাংলা আগ্রাসনের খবর লক্ষণ সেন যে আগেই পেয়েছিলেন সেকথা তো আগেই বলেছি। বাংলার ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধপন্থীদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁরাও ব্রাহ্মণদের মত নেপাল, মিথিলা, উড়িষ্যা , কামরূপ ও ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যান। যাঁরা পালাতে পারলেন না ,তাঁরা আত্মগোপন করলেন।লক্ষণসেন যখন খবর পেলেন বঙ্গ বিজয়ে আসছে বিধর্মী এক বীর যোদ্ধা,বিচক্ষণ লক্ষণ সেন গৌড় থেকে রাজধানী নিয়ে যান নদীয়ার নবদ্বীপে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। লক্ষণসেন নবদ্বীপে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে নদীয়ায় প্রবেশের মূল পথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ে সৈন্য সমাবেশ ঘটান।
কেননা তৎকালীন বিহার আজকের ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় আসার সোজা রাস্তা ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল। সেই জঙ্গল ছিল হিংস্র শ্বাপদ ও সরীসৃপে পূর্ণ। সেক্ষেত্রে স্থলপথে একমাত্র রাস্তা রাজমহল ও তেলিয়াগড় অতিক্রম করে নদীয়ায় প্রবেশ। লক্ষণসেন স্থির নিশ্চিত ছিলেন,শত্রু যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন জঙ্গলের পথে আসতে সাহস পাবে না। কিন্তু জীবনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বড় হওয়া বখতিয়ারের তখন দ্বিগবিজয়ের নেশা। তাই বিপদ জেনেও জঙ্গলের পথ ধরে নদীয়ায় এসে হাজির হলেন তিনি। জঙ্গলের পথে বখতিয়ারের বিশাল সেনা বাহিনী পিছিয়ে পড়েন। মাত্র ১৮জন সেনা নিয়ে লক্ষণসেনের প্রাসাদের দ্বাররক্ষীদের অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের পরাজিত ও বধ করেন বখতিয়ার খিলজি। (চলবে)
আগামী পর্ব: ১৯ ,১৩ জুলাই, শনিবার