সঞ্চারী নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির ৬৬ তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

*

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির। পুলুর মুখেই গল্প শুনতেন তিনি। হ্যাঁ। বাংলা ছবির দুই নায়ক নায়িকা যাঁরা সত্যজিতের ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠতেন সেই পুলু ওরফে সৌমিত্র ও মাধুরী ওরফে মাধবীকে বাংলা সিনেমা জগৎ পেয়েছে তার নেপথ্যে শিশির ভাদুড়ি। সৌমিত্র নিজে বলেছেন,শিশির বাবু তাঁর অভিনয় জীবনের গুরু। তাঁর অভিনয়ে প্রভাবিত হয়েই আমার ছবির দুনিয়ায় পা রাখা। মাধুরী লীলা মুখোপাধ্যায় ও শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। মা ভালো পিয়ানো বাজাতেন। অভিনয়ের ইচ্ছে থাকলেও বাধা ছিল স্বামীর। ফলশ্রুতি বিচ্ছেদ। এরপর লীলা দেবী সিনেমা ও থিয়েটার দুই জগতে কাজ শুরু করেন।শিশির ভাদুড়ির শ্রীরঙ্গম দলে অভিনয়ের সুবাদে মায়ের সঙ্গে মহড়ায় যেতেন ছোট্ট মাধুরী। প্রথম সুযোগ সীতা নাটকে আশ্রম কন্যা আত্রেয়ীর চরিত্রে।

এহেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির ৬৬ তম প্রয়াণ দিবসে কাশীপুর রামকৃষ্ণদেব মহাসমাধি প্রাঙ্গণে গঙ্গার তীরে রামকৃষ্ণদেব, স্বামী অভেদানন্দের সমাধির পাশে সমাধি মন্দিরে নাট্যচার্যের প্রতি 0 শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর আয়োজন করে নাট্য সংস্কৃতির সংস্থা সঞ্চারী। সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ পত্রে ছিল বেশ কিছু অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম। যেমন পাপিয়া অধিকারী, রত্না ঘোষlল, শকুন্তলা বড়ুয়া , ভোলা তামাং, সায়ক, অশোক মুখার্জি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রূপক সাহা,সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু তালিকার একমাত্র রূপক সাহা ছাড়া কাউকে দেখা গেল না। সম্ভবত পেশাগত কাজের চাপে শহরের এক প্রান্তে এসে শিশির ভাদুড়িকে শ্রদ্ধা জানানোর সময় পাননি তাঁরা। তবে এসেছিলেন অভিনেতা মৃত্যুন হাজরা,৬০/৭০ দশকের অভিনেত্রী তপতী ভট্টাচার্য, গায়িকা রুমা ঘোষ প্রমুখ। ছিলেন অনুষ্ঠানের অন্যতম হোতা পরিচালক নারায়ণ রায়। নারায়ণ বাবু জানান, রাষ্ট্রের পদ্ম পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান করে শিশির ভাদুড়ি বলেছিলেন, আমার ব্যক্তিগত সম্মান চাই না, চাই একটি নাট্যমঞ্চ । সুব্রত মুখার্জি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই গঙ্গার ধারে শ্মশানে সমাধি তৈরির জমি কিনে সমাধি ও মূর্তি গড়ে তুলি । এক সময়ে সৌমিত্র, অনুপকুমার, উৎপল দত্ত এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতেন। বলতে হয় উত্তমকুমার ও রাজকাপুরের কথা। ওঁরা আর্থিক অনুদান দেন এই স্মৃতি সৌধ ও মূর্তি নির্মাণে। নাট্য সংস্কৃতির প্রতি নাড়ির টান আর নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির প্রতি শ্রদ্ধা তাঁদের টেনে এনেছে নাট্যাচার্যের সমাধিতে। হলো মাল্যদান পর্ব। কতিপয় অনুরাগীর উপস্থিতিতেই বুঝি খুশি ছিলেন শিশির ভাদুড়ি। অনুভবে বোঝা যায় , নাট্যাচার্য বোধহয় মধু কবির ভাষায় বলছেন, দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল এ সমাধিস্থলে,,,, স্মরণ করা যেতে পারে মধু কবির চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন শিশির ভাদুড়ি। নাট্যাচার্য শিশিরের মৃত্যুদিন ৩০ জুন। মধুকবির মৃত্যুদিন ২৯ জুন। মাঝে কিছু সময়ের ব্যবধান।শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দক্ষতার জন্য তাঁকে বাংলার গ্যারিক উপাধিতে ভূষিত করেন অনুরাগীরা।

শিশির যুগ ছিল বাংলা নাট্য জগতের এক স্মরণীয় কাল। গিরিশ যুগ পেরিয়ে সেই নতুন যুগের সুচনা শিশির ভাদুড়ি করেছিলেন মঞ্চ আঙ্গিকে এক বিপ্লব এনে। ত্রিমাত্রিক মঞ্চ নির্মাণ, আলোর যুক্তিপূর্ণ ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিশির ভাদুড়ির অভিনয়েরও প্রশংসা করেন তিনি। তাঁর সাতটি নাটক প্রযোজনা করেন শিশির ভাদুড়ি। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে কেদারের ভূমিকায় অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। ঐ পার্টে আমার যশ ছিল। অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে শিশিরবাবু নাট্য অভিনয় ও পরিচালনা পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় বাংলা পেয়েছিল নাটকের জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে লেখেন উপন্যাস। উপন্যাস লেখেন ব্রাত্য বসু।

আসলে শিশির ভাদুড়ির চরিত্রের বিভিন্ন আঙ্গিক ঘটনাবহুল। স্ত্রী ঊষাআত্মহত্যার জবানবন্দিতে বলেছেন, স্বামীর উদাসীনতা নিয়ে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলাম। হয়ত অভিনেত্রী প্রভা ও কঙ্কাবতীর সঙ্গে শিশির বাবুর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেননি শিশিরজায়া। শিশির বাবু সেই উপলব্ধি থেকেই বন্ধুবর ভাষাচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, মেয়েদের সম্বন্ধে কখনও উদাসীন হোস নে সুনীতি। ঘটনাটি ঘটে ২৮ মে ১৯১৬। সম্ভবত বঞ্চিত সীতা চরিত্রের প্রতি শিশির ভাদুড়ির দুর্বলতা এই কারণেই। বিষয়টি নিয়ে নাটক করেছেন। সিনেমাও করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছ থেকে আগেই সীতা স্বত্ব নিয়ে রাখে প্রতিযোগী নাট্যসংস্থা। সেও ছিল একটা পরিকল্পনা। শিশিরের উত্থান যাঁদের চক্ষুশূল হয়েছিল।

ততদিনে শিশির ভাদুড়ি বিজ্ঞাপন করে দিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে সীতা মঞ্চায়ন করে অবতীর্ণ হতে চলেছেন শিশির। তখনকার মত অন্য নাটক নিয়ে মঞ্চায়ন করলেও একগুঁয়ে শিশির বন্ধু যোগেশ চৌধুরীকে: দিয়ে মনের মত নাট্যরূপ দিলেন সীতার। নাটকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে বাস্তবোচিত করতে পরামর্শ নেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের ওঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের। গান লিখলেন হেমেন্দ্র কুমার রায়। সুর দিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। মঞ্চসজ্জা করলেন চারু রায়। মঞ্চে প্রথম হাজির করলেন একসঙ্গে একশ অভিনেতা। সীতা নাটকের প্রথম রজনীতে এলেন রবীন্দ্রনাথ। মঞ্চ প্রয়োগ ও অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করলেও নাটকটি নাটক হিসেবে স্বীকৃতি দেন নি। ইংরেজ শাসনের বিরোধী ছিলেন শিশির ভাদুড়ি। তাই সমসাময়িক কালে নতুন ধারার বিজন ভট্টাচার্যের নাটক নবান্ন তাঁর মঞ্চে অভিনীত হতে দেননি। কারণ তাঁর ধারণা ছিল বামপন্থীমনস্ক এই নাটকের কুশলীরা ইংরেজের দালাল। পরে আত্মসমালোচনা করে নিজেই বলেন,আমি ভুল করেছি, আমার মঞ্চে নবান্ন অভিনয়ের সুযোগ না দিয়ে। শিশির ভাদুড়ির কলিজার জোর ছিল বলেই আত্মসমালোচনা করে বুঝেছিলেন, নাটকের সাধনা করতে গিয়ে স্ত্রীকে অবহেলা করেছেন। নবান্ন নাটকের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেছেন, তেমনই স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের কাছে চেয়েছিলেন একটি নাট্যমঞ্চ। কিন্তু পাননি। রাষ্ট্র তাঁকে পদ্ম পুরষ্কার দিয়ে সম্মানিত করতে চাইলে তিনি এই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, এই পুরষ্কার নেওয়ার অর্থ রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। সেটা সম্ভব নয়।

এমন একজন আত্মসম্মানবোধের দঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষের মৃত্যুদিন নিঃশব্দে নীরবে কেটে গেল। বাঙালির উদাসীনতার চরম উদাহরণ। তবু কিছু মানুষের যে কৃতজ্ঞতাবোধ আছে ,সেটাই প্রমাণ করল সঞ্চারী নাট্যসাংস্কৃতিক সংস্থা। তখন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের ছন্নছাড়া কবিতাটি মনে পড়ে। আছে আছে প্রাণ আছে,,, ,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *