পর্ব :১৭
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বৈদিক যুগে বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উৎসবে যেমন সাধারণ নারীদের যোগদানের অধিকার ছিল তেমন গণিকাদেরও অধিকার ছিল। ঋগ্বেদের ভাষ্যে এই উৎসবে যোগদানকারী গণিকাদের বলা হত সভাবতী যোষা। এঁরা উৎসবে আসতেন অধিপেশ অর্থাৎ এমব্রয়ডারি করা পোশাক পরে। তবে বক্ষ থাকত উন্মোচিত।সে যুগে বরুণ প্রঘান নামে এক অনুষ্ঠান হত। সেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত যজমানের স্ত্রীকে তাঁদের গোপন প্রেমিক আছে কি না জিজ্ঞাসা করা হত। মহাব্রত নামে এক অনুষ্ঠানে ছাত্ররা গুরু গৃহে পাঠ শেষ করার পর গণিকাদের সঙ্গে গালিগালাজের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন।
মৎস্যপুরাণে বর্ণিত আছে কৃষ্ণের ১৬ হাজার গোপিনী এক সময় কৃষ্ণকে স্থায়ী ভাবে না পেয়ে অন্য পুরুষে আসক্ত হলে রেগে যান কৃষ্ণ। তিনি গোপিনীদের অভিশাপ দেন তাঁরা যেন দস্যুদের হাতে ধর্ষিতা হন। ধর্ষিত হওয়ার পর গোপিনীরা বেশ্যা জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। মৎস্যপুরাণে এঁদের বলা হয়েছে পণ্যস্ত্রী। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ (২১২) ও মহাভারতে (১৬/৫/১৩৫,১৪৪;৭/২২২-৭০) উল্লেখ আছে এই কথা। আগের পর্বে বিভিন্ন গণিকাদের কথা আলোচিত হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আবার যাচ্ছি। গণিকাদের শ্রেণী বিভাগ যেমন ছিলতেমন ছিল উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণী। সঠিকভাবে বলা উচিত তিন শ্রেণী। সাধারণ, রক্ষিতা ও গোপনচারিনী। সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমলা দেবী তাঁদের ভারতীয় সমাজে প্রান্তবাসিনী গ্রন্থে ( প্রকাশক সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার) লিখেছেন, কোন কোন নিম্নশ্রেণীর বারবণিতারা কলঙ্কিত বস্তিগুলিতে একা অথবা কারও সাময়িক স্ত্রী রূপে বাস করে কেউ; গরীব শ্রমিকদের সম্ভোগার্থে অলিগলির মোড়ে বা খোলার ঘরের দরজায় নিশুতি রাত পর্যন্ত প্রতীক্ষায় থাকে। উচ্চশ্রেণীর বেশ্যারা বড় বড় অট্টালিকায় এক একটি ঘরে এক একজন বাস করে। নিজ নিজ উপপতির কল্যাণার্থে কখনও কখনও এরা সন্ধ্যাবেলায় সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে ধূপধুনা দেয় এবং হিন্দু প্রথানুসারে পূজা করে। উপপতিদের নাম ধাম এরা কখনও প্রকাশ করে না। কোন কোন স্থানে হিন্দু মুসলমান বা খ্রিস্টান যে সম্প্রদায়ের নারীই এই বৃত্তি অবলম্বন করে, সেই হিন্দু নাম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে।( পৃষ্ঠা ১৩)।
১৯৯১ সালের ১৮ এপ্রিল সংখ্যা দেশ পত্রিকায় শিবাশিস বন্দোপাধ্যায় তাঁর গণিকা বৃত্তি: সমাজ, সংস্কার এবং সমীক্ষা প্রতিবেদনে লিখেছেন তারাপদ ভট্টাচার্যের মন্তব্য। তারাপদবাবু জানান, প্রাচীন ভারতে গণিকাদের একটা শ্রেণী ছিল যারা অন্তত সাধারণ স্তরের। নগরের বাইরে তারা থাকত রাম শ্যাম যদু মধু জন্য। কিন্তু যারা সত্য সুন্দরী ও শিক্ষিতা ছিলেন তারা ছিলেন প্রাচুর্যে লাস্যে, ছলা কলায়, নৃত্যে, গীতে, বাদ্যে, লিপি অঙ্কনে কুশলীনী ছিলেন। তাঁদের কাছে সভ্রান্ত, অভিজাতবর্গ, রাজারাজড়া ও বণিকদের যাতায়াত ছিল। তাঁরা নগরের ভেতর থাকতেন। ঠিক সামাজিক আদান প্রদান না থাকলেও অসম্মান নিয়ে বাঁচার গ্লানি তাদের মধ্যে ছিল না ।( চলবে)
পর্ব: ১৮ আগামী শুক্রবার ১৪ জুন,