বেশ্যার বারোমাস্যা

পর্ব: ১৩

কোলকাতার বাবুদের বাগানবাড়িতে বাঈনাচের আসর

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে ইংরেজ নিজেদের স্বার্থেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক কেরানিকূল সৃষ্টি করে, তেমনই এক নব্য জমিদার শ্রেণীও গজিয়ে ওঠে। কাজকর্ম বিশেষ নেই। মানুষের খাজনা আর ঠিকেদারি ও রপ্তানি কিম্বা মজুত পণ্যের ব্যবসায় লাভ বাড়তে থাকে। ফলে ফুর্তির খরচে কার্পণ্য থাকে না। লক্ষাধিক ব্যয়ে কুকুর বিড়ালের বিয়ে থেকে বাঈ নাচ, বেশ্যাগমনে সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে। সেযুগের পত্রিকা সম্মাদ সুধাকর পত্রিকায় লেখা হয়,,,,,,,চেতো পরগণা নিবাসী বিপ্র সন্তান লিখিয়াছেন, যে ইঙ্গরেজি বিদ্যা শিক্ষা করণাশয়ে তিনি স্বদেশ পরিত্যাগপূর্বক কলিকাতায় উপনীত হইয়া সুযোগক্রমে প্রতন্নগরস্থ কোন প্রধান ব্যক্তির ভবনে বাসা করিলেন। দিবা অবসানে যখন ওই বিপ্রসন্তান স্বয়ংসন্ধ্যা করিয়া বসিয়াছিলেন তখন বাটীর বৃদ্ধ কর্তা তৎপরে তাঁহার জেষ্ঠ্য ও মধ্যম পুত্র ও পরে কনিষ্ঠ পুত্রও ইহারা একে একে তাবতেই বাটী হইতে বহির্গমন করিলেন, তৎপরে দুইজন দৈবাবিক ও অন্য কোন চাকর অন্দরমহলে প্রবেশ করিয়া নিশাবসান করিল, যাবৎ কর্তা ও তাঁহার পুত্ররা বাহিরে যামিনী যাপন করিয়া প্রাতঃকালে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

সেকালে জমিদার বাড়ির পুজো শিল্পীর পেন্সিলে।

দুর্গাপুজোর দশমীর রাত বর্ণনা করতে গিয়ে হুতুম প্যাঁচা লিখেছেন,,,,,,, ক্রমে শহরের বড় রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, বেশ্যালয়ে বারান্দা আলাপীতে পুরো গ্যালো। ইংরাজি বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সাইন সঙ্গে প্রতিমারা রাস্তার বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন, তখনকার প্রতিমা কার সাজ ভাল, কার সরঞ্জাম সরেস প্রভৃতি প্রশংসাই প্রয়োজন হচ্চে, কিন্তু হায়! কেউ সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে না, কম্মকর্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না। এদিকে প্রসন্নবাবুর ঘাট ভদ্দর গোছের দর্শক , ক্ষুদে ক্ষুদে পোশাক পড়া ছেলেমেয়ে ও ইস্কুল বয়ে ভরে গেল। কর্মকর্তা কেউ কেউ নৌকা নিয়ে বাচ খেলিয়ে বেড়াতে লাগলেন, আমুদে মিনসে ও ছোঁড়ার দল নৌকোর ওপর চোলের সঙ্গতে নাচতে লাগল। সৌখিন বাবুরা খ্যামটা ও বাঈ সঙ্গে করে বোট, পিনেশ ও বজরার ছাতে বার দিয়ে বসলেন মো সাহেব ও ওস্তাদ চাকরেরা কবির সুরে দু একটা রংদার গান গাইতে লাগল। বিদায় হও মা ভগবতী এ শহরে এসো নাকো আর, দিনে দিনে কলিকাতার ম্মর্ম দেখি চমৎকার,,,,,,

বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র

যৌনাকাঙ্ক্ষা মানুষের আদিম রিপু। এই বিষয়ে সর্বকালের বিখ্যাত গ্রন্থগুলির অন্যতম বাৎস্যায়নের কামসূত্র। বাৎস্যায়ন বলেছেন, একজন গণিকাকে ৬৪ রকমের কলা ও ৬৪ রকমের যৌনকলা জানা আবশ্যিক? এই ৬৪ কলার মধ্যে আছে ২২৪ রকমের কামকৌশল,২০ রকমের ছলাকলা,১৬: রকমের শয়নকক্ষের বর্ণনা ও ৪ রকমের উত্তর কলা। কত্রভার রচনা আর ৬৪ রকমের পঞ্চালিকা কলারও বর্ণনা আছে কামসূত্র গ্রন্থে। সেই গ্রন্থে বর্ণনা আছে একজন গণিকা কী ধরণের লোকেদের কী ভাবে আকর্ষিত করবে এবং তাদের সঙ্গে কী ধরণের ব্যবহার করবে। বাৎসায়নের নির্দেশ, গণিকারা তাদের গয়না চুরি গেছে বলে নতুন খদ্দেরদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারে। কুম্ভদাসী বর্গের গণিকারা খাদ্যের দোকান করে লাভের টাকায় প্রসাধনী কিনবে। এছাড়াও নটী, পরিচালিকা, বিনষ্টা ,স্বৈরচারিনী , শিল্পীকারীরা শ্রেণীতে গণিকাদের চিহ্নিত করা হত।

আচার্য কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রচ্ছদ।

এমনই এক কাব্য কাশ্মীরের দামোদর গুপ্তের কূটনিমত ( ৭৭৯-৮১৩ খ্রি:)। যে কারৎমালা কাব্যে মালতী নামে একজন গণিকাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, সে যেন প্রেমের ফাঁদে ধনী কোনো পুরুষকে মোহিত করবে। যেন প্রেমিক বুঝতে না পারে যে তাকে শিকার করা হচ্ছে। এই কাব্যে পুরুষ বশ করারও কৌশল বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্য থেকে বোঝা যায় খ্রিস্টীয় নবম শতকে সমাজে উচ্চমানে গণিকার চাহিদা ছিল। এমনই আরেক গ্রন্থ কলহনের রাজ তরঙ্গিনী। যদিও গ্রন্থটি শুধু যৌনবিষয়ক নয়। সমাজের বহু বিষয়ের উল্লেখ আছে। রাজা হর্ষের সভাকক্ষে গণিকাদের প্রবেশ ছিল অবাধ। রাজা জয় পীড় পুণ্ড্রবর্ধন কার্তিক মন্দিরে ভ্রমণের সময়ে কমলা নর্তকীর বাড়িতে আমন্ত্রিত হন। মহাকবি কালিদাসের বর্ণনায় আছে গণিকাদের সাজসজ্জার বর্ণনা। কী ভাবে পুরুষকে প্রলোভিত করে তোলা উচিত সে সম্পর্কে গণিকাদের পোশাক কেমন হবে ., আলিঙ্গন কী করে করতে হবে তারও বিবরণ আছে কালিদাসের কাব্যে।( চলবে)

আগামী পর্ব ১৪ ও ১৫, শনিবার ২৫ মে ও রবিবার ২৬ মে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *