বাঙালির ইতিহাস ও বহিরাগত তত্ত্ব

পর্ব ৭

করোনা সময়কাল। হঠাৎ একদিন সকালে ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধু কুণাল ঘোষের ফোন। কুশল বিনিময়ের পর কুণাল জানালো বাড়িতে যখন বন্দী।, তখন একটা গবেষণামূলক লেখা লিখুন। আমি ই বুকে প্রকাশ করব। বিষয়টি সেই নির্বাচন করে দিল। বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাস। শুনেই চমকে উঠেছিলাম। কাকে দিচ্ছ রাজার পার্ট। আমি সামান্য এক ক্ষুদ্র সাংবাদিক। এই বিশাল ব্যাপ্তির কাজে হাত দেওয়া মানে সাপের গর্তে হাত ঢোকানো। তবু অনড় কুণাল। ওঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার হাজার যোজন দূরের সস্পর্ক। কিন্তু কলকাতায় যখন কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব ছিল না তখন কলকাতা দূরদর্শনে বেসরকারি প্রযোজনায় সংবাদ ম্যাগাজিন তৈরির দুঃসাহস তো দেখিয়েছিলাম কুণালের মত তৎপর সাংবাদিককে পাশে পেয়েছিলাম বলে। বাংলার টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যদি পত্তন করতে পারি সাফল্যের সঙ্গে, তবে এই কাজটাও পারব ।। সবচেয়ে বড় কথা,, এই লেখায় আমার কৃতিত্ব নেই। আমার কাজ তো তথ্য সংগ্রহ করে মালা গাঁথা। করোনা প্রবাহে শুরু করেছিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম বাংলার ঐতিহাসিকদের বহুলাংশই উচ্চবর্ণের মানুষ। ফলে ভূমিপূত্র বাঙ্গালির ইতিহাস, সংস্কৃতি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই আমার তথ্য খোঁজার কাজটা হলো গোয়েন্দার সূত্র খোঁজার মত।

সেই খুঁজে পাওয়া তথ্য যদি বাঙালির কোনো কাজে লাগে সেই আশায় পর্ব অনুযায়ী পরিবেশন করতে চলেছি। শুধু প্রশংসা নয়,সমালোচনাও চাই। তবে তো নিজের ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধন করত পারবো। বিষয়টি যেহেতু কুণাল ঘোষের অনুপ্রেরণায় তাই লেখাটি তাঁকেই উৎসর্গ করছি।

বাংলার আদি অস্ট্রিক মানুষ।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বাঙালি নিজের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে, কিন্তু বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন। অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, জবাব পেয়েছি, কি হবে অত ভেতরে ঢুকে। জেনে কি লাভ? অর্থাৎ এই মুহুর্তে আর্থিক লাভের সম্ভাবনা আছে কি? বোঝা উচিৎ নিজের জাতি সত্ত্বা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে নিজের শিকড়ের খোঁজ না নিলে কালের নিয়মে বিলুপ্ত হওয়া ছাড় উপায় নেই। সেই কবিতাটা মনে পড়ছে। জানেন দাদা,আমার ছেলের বাংলাটা ঠিঠাকমতো আসে না। সদ্য প্রয়াত ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতা।তিনি আজকের বাঙালিকে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে সমালোচনা করেই লেখেন ইংলিশ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ফাস্ট ল্যাঙ্গোয়েজ। হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ। কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে? বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে? বেঙ্গলি থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ তাই, তেমন ভালোবাসে না অপূর্ব দত্তের আর একটি কবিতা। বাংলা টাংলা।,,,,,,,, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ নেহাত ছিলেন বোকা, না হলে কেউ শখ করে হয় বাংলা বইয়ের পোকা। মা বলল চুপ করো তো ওর ফল্ট টা কিসে, স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা পড়ায় না ইংলিশে? দুটি কবিতা উল্লেখ করলাম প্রাসঙ্গিক হিসেবে। আজ পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাস ও বহিরাগত তত্ত্ব শিরোনামে যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন সপ্তাহে দুটি ছুটির দিনে প্রকাশ করছি , আজ যেটির পর্ব ৭, সেখানে প্রতিবেদনটি পড়ছেন এমন পাঠক হাতে গোনা। হয়ত আমার ব্যর্থতা, লেখাটি হয়তআকর্ষণীয় নয়, না হলে বাঙালি আজও কাঁচা ঘুম থেকে জাগতে চাইছে না।

সে যাই হোক, আমার কাজ আমি করছি, ভবিষ্যত বলবে, এ লেখার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। বিষয়ে ফিরে আসি। বাঙালির উদ্ভব প্রসঙ্গ চলছে গত দুটি পর্ব থেকে। প্রথমেই সাহায্য নেব ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের। তিনি তাঁর বাঙালির ইতিহাস আদি পর্বের ইতিহাসের গোড়ার কথা শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লিখেছেন,,,,,,, বাংলাদেশে জনতত্ত্ব গবেষণার মাত্র শৈশবাস্থা। সময়টা কখন? সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ভূমিকা তিনি লেখেন ১৯৬৭ সালে। অর্থাৎ বাঙালি রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার কুড়ি বছর পরের কথা। আজ স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও কি বাঙালির জনতত্ত্ব গবেষণা খুব বেশি এগিয়েছে? বাঙালি এত ক্রিকেটপ্রেমী, এখনও ব্যাট বলের বিকল্প বাংলা শব্দের সৃষ্টি করতে পারেনি। হিন্দি ধারাবিবরণী শুনলে দেখবেন ওরা বলকে গেন আর ব্যাটের হিন্দি শব্দ বল্লে বলে থাকে। আসল কথায় ফিরি। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি বাঙালির আদি কোনো একক জাতির নয়। নিগ্রো বটু, দ্রাবিড়, মঙ্গোলিয়ান ও অ্যালপেনিয় গোষ্ঠীর মিশ্রণ। অর্থাৎ সংকর জাতি।অ্যালপেনিয় শব্দ এখন টিঁকে আছে খবরের কাগজের পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনে। অ্যালপেনিয় গোত্রের পাত্রপাত্রী চাই। যাঁরা বিজ্ঞাপণ দেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করলে শতকরা ৯৯ শতাংশ কারণ এবংএই গোত্র কি বলতে পারবেন না।বংশ পরম্পরায় শুনে বলে চলেছেন। আলপাইন বা অ্যালপেনিয় জনআর্য জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের পর বাংলায় এঁরা একসময় জনবসতি গড়ে তোলে। আল্পস পর্বতমালা, পামির মালভূমি ও পূর্ব ভারত থেকে বাংলায় আসায় তাঁদের হোমোআল পাটনাস বলা হয়। জাতিতে তাঁরা বৈদিক ছিল না। কিন্তু আর্যভাষায় কথা বলত। বাংলায় আর্য আগমনের আগেই উন্নত সভ্যতার বিকাশ তাঁরা ঘটিয়ে ছিল।

আর্যদের বসতি বিস্তৃত হয়েছিল ভারত থেকে ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত।

অতুল সুর লিখেছেনএকই কথা। এঁরা ওড়িশা, বিহার কাশী ও অসমে বসতি গড়ে। মনে রাখা দরকার ১৫ শ অব্দে অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করলেও বাংলাতে তাঁরা আসেন অনেক পরে। এঁদের আগ্রাসী নীতিতে বাংলার ভূমিপূত্র বাকিরা অরণ্যে গিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করে। ফলে খুব সহজেই বাংলায় আর্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌর্য বংশ থেকে খ্রিস্টীয় ৫ শ অব্দ পর্যন্ত মোট ৮ শ বছর বাংলায় আর্যীকরণ চলতে থাকে। গুপ্ত যুগে এসে বাংলাদেশে ভাষা ও সংস্কৃতি একটা রূপ পায়। খ্রিস্টীয় ৮ ম শতাব্দীতে সিন্ধু বিজয়ের পর ভারতে আরবীয় মুসলমানেরা এখানে স্থিত হয়। বাঙালির জাতি পরিচয়ে ড্রানির ও অস্ট্রিকদের অবদান যথেষ্ট সন্দেহ নেই। তবে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে অষ্ট্রিকদের অবদানই বেশি। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এ সি হ্যাডন তাঁর রেসেস অফ ম্যান গ্রন্থে বলেছেন, আর্যরা বাংলায় আসার আগে পাঞ্জাব থেকে উত্তরপ্রদেশ বসতি গড়েছিল। তাঁদের বসতি গড়ে ওঠে ভারত থেকে ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত? ইস্টার দ্বীপ চিলি থেকে n২৩০০ মাইল পশ্চিমে। এই দ্বীপের নামকরণের সঙ্গে ইস্টার খ্রিস্টধর্মের ধর্মীয় রীতির সম্পর্ক আছে।১৭৬২ সালে এক ভূপর্যটক অ্যাডমিরাল জ্যাকব রোগে ভিন দ্বীপটি ভুলবশতঃ আবিষ্কার করে ফেলেন। অস্ট্রিক জাতির মানুষেরা যখন এই দ্বীপে বসবাস শুরু করেন নাম দেয় তে পিতো ওতে হনুয়া। আগ্নেয়গিরির লাভা জমেই এই দ্বীপের সৃষ্টি। আগামী পর্বে ফিরে যাবো দ্রাবিড়গোষ্ঠীর কথায়।

পর্ব: ৮ , রবিবার ১৯ মে ২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *