*
পর্ব: ১২
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বাংলার ১৯ শতকের নব্য বাবুদের আমোদ প্রমোদে বেশ্যা যেমন উপকরণ তেমন ছিল বাঈজি প্রীতি। আজও অনেকে বেশ্যা ও বাঈজি একনজরে দেখেন। কিন্তু বেশ্যার পেশা শরীর বিক্রি। বাঈজির পেশা অর্থের বিনিময়ে গান নাচ পরিবেশন করতেন। তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স থাকে। আজও আছে। সময়টা মনে রাখা দরকার। না ছিল রেডিও, না গানের কল। রেকর্ড। সমাজে মহিলাদের গান ও নাচ ছিল নিষিদ্ধ। ফলে বিকল্প বাঈজি। পুরাঘেঁটে দেখুন। বেহুলা সাপে কাটা স্বামী লক্ষিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে কলার ভেলায় চড়ে পাড়ি দেন। নদী বক্ষে। আজও কুসংস্কারের এমন বিশ্বাসের কারণেই আজও এই প্রথার খবর মেলে। অনুমান জলে হাওয়ায় সাপের বিষ কাটতে জল হাওয়া কাজ করে। মনসামঙ্গল কাব্যে আছে ভেলা নিয়ে বেহুলা পৌঁছে ছিলেন কলকাতার কাছে ত্রিবেণী সঙ্গমে। যেখানে গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গম। এই ঘাটেই ছিল নেতাই ধোপানির ঘাট। কাব্য বলছে ধোপানির দুষ্টু শিশু কাপড় কাচার কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বলে সে পুত্রকে ঘাটে এনে মেরে ফেলে। তারপর কাজ সেরে ত্রিবেণী সঙ্গমের জল ছিটিয়ে পুত্রের জীবন এনে বাড়ি ফিরত। সেই বেহুলাকে পরামর্শ দিয়েছিল স্বর্গে গিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে।
সেই কাপড় কাচার পাথর নাকি এখনও আছে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। স্বর্গে গিয়ে যখন নিজের স্বামীর প্রাণভিক্ষা চান বেহুলা দেবতাদের কাছে, দয়াবান দেবতারা জানালেন গিভ অ্যান্ড টেক পলিসির কথা। লাস্যময়ী নৃত্য পরিবেশন করে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে বেহুলা বেস্বামীর জীবন ফিরে পান।মনে কর দেখি, একজন স্বামী শোকে কাতর অসহায় নারীর লাস্যময়ী নৃত্যে যৌনতার সুড়সুড়ি পেতে চাইলেন দেবতারা। মানবিকতার পরাকাষ্ঠা যাকে বলে। উনিশ শতকে নব্য বাবুদের স্ত্রীদের কাজ ছিল সন্তান উৎপাদন ও স্বামী সেবা। স্বাভাবিক যৌনতা কতদিন আর ভালো লাগে? একটু ছলাকলা,একটু ঢং, একটু দুষ্টু দুষ্টু অঙ্গভঙ্গি যদি না উপভোগ করা গেল তাহলে যৌন আবেদনের নেশা মনে ধরবে কেন? সেই সব ছলাকলা হিন্দিতে বলে নখরা। এই ব্যাপারে গান নাচের সঙ্গে বাঈজিরা পরিবেশন করতেন। অনেকসময় এঁরা একক কোন বাবুর রক্ষিতা হয়ে থাকতেন। অনেকে টাকা দিলেও অন্য পুরুষের সামনে তাঁরা নাচ গান করতেন না। তবে সেই নাচিয়ে গাইয়ে মেয়েদের বেসন্তান সমাজে স্বীকৃতি পেত না। বাঈজির কন্যা সন্তানের ভবিতব্য একই ছিল। পুরুষ সন্তান হলে বাজিয়ে।
এইসব ছলা কিন্তু বাৎস্যায়নের কাম শাস্ত্রে কলা হিসেবে স্বীকৃত। ধরা যাক চুম্বন। ঠোঁটে ঠোঁটে মিলন চুম্বন। বাৎসায়ন নারীদেহে আটটি স্থানে চুম্বনের কথা লিখেছেন কামশাস্ত্র গ্রন্থে। নারী দেহের ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষ, স্তন, ওষ্ঠ ও ওষ্ঠান্তর্মুখ। অলক অর্থাৎ কপালের পাশে ঝোলা চুল অর্থাৎ যাকে আমরা জুলপি বলি। লাটদেশীয় অর্থাৎ গুজরাটের পণ্ডিতরা নারীর দেহের আরও কয়েকটি স্থানে চুম্বনের কথা বলেছেন। যেমন নাভি, উরুসন্ধি, বাহুমুল। তাছাড়া। এসব তো স্ত্রীর কাছে আশা করা বৃথা। কেননা স্ত্রীরা তো লজ্জাবতী লতা। তাছাড়া নখের আঁচড়ে যে যৌনসুখ সেকি স্ত্রীর ওপর ফলানো যায়। বেশ্যাদের আবার শ্রেণী ভেদ ছিল প্রাচীন যুগে। কামশাস্ত্র জানা বেশ্যারা ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে। সেও তিন রকম।তাঁদের বলা হত উত্তমা, রূপা জীবা, কুম্ভদাসী।
উত্তমারা মন্দির স্থাপন করতে পারতেন নিজস্ব আয়ে । সরোবর ও সেতু নির্মাণ, ব্রাহ্মণকে গীতা দান ও দেব পূজার অধিকার ছিল। রূপাজীবীদের অঙ্গময় অলঙ্কার পরিধান করে থাকতে হত আজকের সিরিয়ালের নারী চরিত্রের মত , বৃহৎ গৃহ নির্মাণের অনুমতি ছিল। ছিল শৈল্পিক গৃহসজ্জার শর্ত। কুম্ভদাসীদের পোশাক হত সাদা, মদ্যপানে আসক্ত, সুগন্ধি পান চিবানো। এইসব গণিকা যখন বৃদ্ধা হত তাদের মাতৃকা ব্রত পালন করতে হত। সে আর দেহদানের উপযুক্ত নয় বলে ঘোষিত হত। মাতৃস্থানীয় হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেই বেঁচে থাকা। কোনো কারণে বয়স থাকলেওভোগ্যা হিসেবে স্বীকৃতি হারালে রাজার কোষাগারে বা মহানসে ( রান্নাঘরে) দাসীর কাজ করতে হত। যদি কোনো দাসীকে রাজা বা আমত্যের পছন্দ হত তাহলে ঘরে তাকে আটকে রেখে দেওয়া হত। কিন্তু মাসিক বেতন একটা দেওয়া হত। নব্যবাবুদের কথা বলতে গিয়ে টাইম মেশিনে চেপে অতীতে চলে গিয়েছিলাম। আগামী সংখ্যায় আবার বাংলার বাবুদের বেশ্যা ও বাঈজি প্রীতির ঐতিহাসিক তথ্য দেব ।( চলবে)
পর্ব: ১৩, আগামী সোমবার ২২ মে,২০২৪।