*
পর্ব ১১
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: অপ্সরা প্রসঙ্গ থেকে ফিরে যাবো হিন্দু শাস্ত্রে। শুক্ল যজুর্বেদে ( ৩০/৫-৬,২২) পুংশ্চলী ও কুমারী পুত্রের উল্লেখ আছে। অথর্ববেদেও আছে। ঐতেরেয় ব্রাহ্মণে’র (১/২৭/১) মহা নগ্নি’র অর্থও বেশ্যা। যজুর্বেদে বাজসনেয়ী সংহিতায় (৩০/১৫) অতীত্বরী, বিজর্জরা শব্দ দুটিরও মানে বেশ্যা। এই সংহিতায় অসোগূ মানেও বেশ্যা। স্মৃতি শাস্ত্রে বিবাহে ভাতৃহীনা কন্যাকে অপ্রশস্ত বলা হয়েছে। কারণ পুত্রহীনা ব্যক্তিরা মনস্থ করবেন , ভবিষ্যতে বিবাহিতা কন্যার গর্ভজাত পুত্র মাতামহের পুত্র হিসেবে সমাজে পরিচিত হবে। এই পুত্রকে বলা হত পুত্রিকাপুত্র ঋকবেদে বিভিন্ন সময় বেশ্যাদের প্রবেশে প্রবেশে অনুমতি ছিল। এঁদের বলা হত সভাবতী ঘোষ। ঋকবেদে অধি পেশ বা সেলাই করা পরিচ্ছদে ভুষিতা বক্ষ উন্মোচনকারিনী নর্তকী ঊষা (১/৯২/৪,১০/৯৫/৯),। অনেক শাস্ত্রে ঊষাকে গণিকার দেবী রূপ বলা হয়েছে।
ঋকবেদীয় যুগে বরুণ প্রমাণ নামে এক বৈদিক অনুষ্ঠান হত। সেখানে বিবাহিতা নারীর গোপন প্রেমিক সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হত। মহাব্রত অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ ছাত্র ও গণিকা পরস্পর অশ্লীল শব্দের খেলা খেলতেন। পুরাণে পরাশর মুনি নিজের কন্যার প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও , ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে ভোগ করেন ঋষি গৌতমের ছদ্মবেশে। বায়ুদেব কামকাতর ছিলেন হনুমানের মা অঞ্জনার প্রতি। সূর্যদেব পশু যোনিও পছন্দ করতেন। স্ত্রী ঘোড়ার সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্কের উল্লেখ আছে। রামায়ণে রামের অভিষেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর আসনে স্থান পেয়েছিলেন অযোধ্যাসহ বিভিন্ন রাজ্যের সুন্দরী শ্রেষ্ঠা বেশ্যারা। এমনকি লঙ্কা জয়ের পর রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরলে নগরদ্বারে সর্বপ্রথম অভ্যর্থনা জানায় অযোধ্যার বেশ্যারা। গবেষক কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় তাঁর বইতে এও উল্লেখ করেছেন, বাল্মীকি রামায়ণে আছে ১৪ বছরের জন্য রামচন্দ্র যখন বনবাসে যাচ্ছেন পিতা দশরথ তাঁর মন্ত্রী ও ছায়াসঙ্গী সুমন্ত্রকে বলছেন রামের সুখের জন্য সৈনিকদের সঙ্গে বচন চতুরা গণিকা সঙ্গে দিতে। আর্যরা যখন ভারতে প্রবেশ করে দুর্গম পথ পেরিয়ে সঙ্গে ছিল না তাঁদের স্ত্রীরা। স্থানীয় নারী ছিল তাদের ভোগ্য। এছাড়া কিছু আর্য নারী এসেছিল ঘোড়ার পিঠে চেপে। তারা বেশিরভাগ ছিল বেশ্যা। এমনটাই লিখেছেন সমুদ্র বিশ্বাস তাঁর দুর্গাপুজোর অন্তরালে গ্রন্থে।( ২৭ পৃষ্ঠা) দুর্গা পুজোর অন্যতম উপাদান বেশ্যা গৃহের মাটি। শাস্ত্রকাররা বলেন, বেশ্যাদ্বার পুণ্যশোষী। অর্থাৎ যে পুরুষ বেশ্যাদ্বার পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে তার সমস্ত পুণ্য ওই দ্বার শোষণ করে নেয়। পুণ্যহীন হয় পুরুষ। বেশ্যাদ্বারে জমা হয় পুণ্য। সেই দ্বারের মাটি হয় পবিত্র। দেবী দুর্গার বোধন স্নানে লাগে সেই মাটি।
ঋক বৈদিক যুগ।
দুর্গাপুজোর কথা যখন উঠল ফিরে আসি বাংলায় ১৮ শতকের শেষে। বাংলায় তখন ব্রিটিশের বদান্যতায় নতুন এক জমিদার নব্য বাবু শ্রেণীর উৎপত্তি হয়েছে। জমিদারি আর রপ্তানি আমদানির ব্যবসায় হাতে অনেক টাকা। টাকা মানেই মদ , মহিলা, জুয়া। বাঙালি উচ্চবর্ণের বাবুদের নিষিদ্ধ পল্লীর বিবরণ দিতে গিয়ে কালী প্রসন্ন সিংহ ওরফে হুতুম প্যাঁচা লিখেছেন ,,,,,,, রাজরাজড়ারা রাত্রে নিজ বিবাহিতা স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারোয়ান, মুৎসুদ্দীরা যেমন মনিবের বিশ্ব কর্ম দেখতেন তেমন স্ত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাদের ওপর বর্তাত। সুতরাং তারা ছাড়বেন কেন? কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্বামী স্ত্রীকে বাড়ির ভেতরের ঘরে রেখে বাইরের চাবি বন্ধ করে সারারাত বারবনিতা নিয়ে বাঈ নিয়ে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফেরেন। কলকাতায় ছিলেন বিখ্যাত আট বাবু। বাবু মহলে সেটা। নীলমণি হালদার , রামতনু দত্ত, গোকুলচন্দ্র মিত্র , রাজা রাজকৃষ্ণ দেব, কালী প্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্প নারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখন্ময় রায়, চোরবাগানের মিত্র বংশের একজন।
বাংলার বাবু সমাজে ছিল বেশ্যাগমন সম্মানের বিষয়।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বাবু নামের এক রম্য রচনায় লিখেছিলেন, যিনি উৎসবার্য দুর্গা পূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন তিনিই বাবু। বঙ্কিম পরবর্তী যুগে বাবুরা যে রক্ষিতা বাড়িতে রাত কাটাতেন আগেই উল্লেখ করেছি। দিনের বেলা যাওয়াতে কোনো অসম্মানের ছিল না । বরং মর্যাদার ছিল। পুরুষ মানুষের নারী লিপ্সা না থাকলে সে পুরুষ কিসের? ফলে স্ত্রীরা ছিলেন স্বামীসুখে বঞ্চিত। তাই বোধহয় সম্মাদ সুধাকর পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল ,,,,, কস্য চিৎ চেতো পরগণা নির্বাসিন, বি প্রশস্ত নস্য ইত সাক্ষরিত এক সম্মাদ গত সপ্তাহে প্রকাশিত করিয়াছি। ( চলবে)
আগামী পর্ব ১২ ,১৭ মে, ২০২৪