সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: যে শাস্ত্রে হনুমানের জন্মদিন চৈত্র পূর্ণিমায় বলা হয়েছে সেই শাস্ত্রের নিদান তৈরি পঞ্জিকার বিধানে। হনুমান নিজে সংকটমোচন হলেও পাঁজির সংকট দূর করতে পারেননি। আজ ২৪ এপ্রিল ভোর ৫ টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত পূর্ণিমা থাকায় হনুমান জয়ন্তী বিবেচিত হয়েছে। শাস্ত্রের নিদান হনুমান আরাধনার সেরা ফুল জুঁই। ফল স্বাভাবিক ভাবে পাকা কলা, নারকেল, ছোলা, লাড্ডুগুড়, মরশুমের ফল, চিনি, ঘি ও অন্যান্য মিষ্টি। এছাড়া পান সুপুরি ও তুলসি পাতা ও অবশ্যই। পুরাণে হনুমান নাম সম্পর্কে বলা হয়েছে , সূর্যকে ফল ভেবে হনুমান গিলতে গেলে তাপে পুড়ে পৃথিবীতে আছাড় খেয়ে পড়ে। বাম চোয়াল যায় ভেঙে। চোয়ালের আর এক নাম হনু।। তাই নামকরণ হনুমান। বাল্মীকি কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী হনুমানের জন্মদিন বলেছিলেন। দিনটি নাকি ছিল মঙ্গলবার। তাহলে চৈত্র পূর্ণিমা কেন হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়? আগেই বলেছি হনুমান পুরাণের কাহিনী অনুসারে সূর্যকে ফল ভেবে খেতে যান। সেদিন ছিল সূর্য গ্রহণের দিন। রাহুও এসেছে সূর্যকে গ্রাস করতে। রাহুকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে হনুমান যায় রাহুকে গিলতে।রাহু দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হয়। ইন্দ্র হনুমানকে বজ্রাঘাত করেন। হনুমান ভূপতিত হয় এক পর্বতে। পিতা পবনদেব পুত্রকে নিয়ে পর্বতের এক গুহায় যান শুশ্রূষার জন্য। ফলে ত্রিভুবনে বায়ুপ্রবাহ থেমে যায়। বায়ুশূন্য পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা হনুমানকে পুনর্জীবন দান করেন। সেই দিনটি ছিল চৈত্র পূর্ণিমা। ফলে বাল্মীকির রচনাকে অগ্রাহ্য করেএই দিনটিই হনুমানের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। শিব পুরাণ বলছে, সমুদ্র মন্থনে বিষ্ণুর মোহিনী নারীর ছদ্মবেশ শিবকে কামতাড়িত করে। দুই পুরুষের মৈথুনে হনুমানের জন্ম। তার আগেই নাকি শিবের বীর্য স্খলন হয়। যা পড়ে গিয়ে বানররাজ কেশরীর স্ত্রী ও অঞ্জনার কানে।
কানে বীর্য স্খলনের ফলেই নাকি অঞ্জনা গর্ভবতী হন। জন্ম হয় হনুমানের। আর এক উপাখ্যান বলে , রাজা দশরথ পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞে পায়েস পরিবেশন করা হয় রাণীদের । কৈকেয়ীর বাটি থেকে এক ফোঁটা পায়েস পড়ে যায় মাটিতে। সেই পায়েস এক শকুন নিয়ে যায়। তার ঠোঁট থেকে পায়েস পড়ে অঞ্জনার মুখে। ব্যস। অঞ্জনাও গর্ভবতী। এবার বলি হনুমানের বিয়ে সম্পর্কে। রাজশেখর বসু যিনি পরশুরাম নামে বিখ্যাত ছিলেন তিনি লিখেছেন , হনুমানের একবার ইচ্ছে হয় প্রয়াত পূর্বপুরুষদের পিন্ডদান করার। কিন্তু শাস্ত্রমতে বিবাহিত না হলে পিন্ডদান শুদ্ধ হয় না। তিনি হনুমতী চিলিম্পাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কামশাস্ত্র সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকায় প্রেমিকা চিলিম্পাকে তুলে দেন বন্ধু সুগ্রীবের হাতে। প্রসারভারতীয় প্রাক্তন প্রধান জহর সরকার ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল বাংলার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় শান্তিতে বাঁচতে চাই প্রবন্ধে লিখলেন রামের ব্যাপারটা বরং সরকার সামলাক , আমরা বরং হনুমানের দিকে একটু নজর দিই। আমরা জানতাম তাঁর জন্ম চৈত্র পূর্ণিমায় , যদিও তামিল এবং মালায়লিরা বলেন , তিনি নাকি পৌষ মাসে জন্মেছিলেন। একটা ব্যাপার পরিষ্কার জানা দরকার। হনুমান কি পবনপুত্র? ষোড়শ শতকে লেখা একনাথ এর ভাবার্থে রামায়ণে যেমনটি লেখা আছে? নাকি হনুমান চল্লিশার কথাই ঠিক? সিন্ধু সভ্যতার কোথাও রামের উল্লেখ নেই। বেদেও নেই। কোনো কোনো পণ্ডিত ইন্দ্রের প্রিয় বাঁদর বৃক্ষকপিকে হনুমানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
জহরবাবু লিখেছেন প্রাক আর্য বা দ্রাবিড় সভ্যতা সংস্কৃতিতে রামের আরাধনাকে স্বীকৃতি দেয়নি। বস্তুত দক্ষিণ ভারতে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি উত্তর ভারত তথা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরূদ্ধে যে আন্দোলন হয়,তার নায়ক পেরিয়ার এবং তাঁর অনুগামীরা প্রবল অভিযোগ করেছিলেন যে রামায়ণে দক্ষিণ ভারতের অপমান করা হয়েছে। উনিশ শতকের ভারতবিদ এডওয়ার্ড মূর এর বক্তব্য , ভারতে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল যে শ্রীলঙ্কায় বানর এবং রাক্ষসরা বাস করে তাই পুরোহিত ও কবিরা রামের অভিযানের কথা লেখার সময় মহাকাব্যে সেই জনপ্রিয় ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতিবেদন ঘটিয়েছিলেন।এইচ সি লাল আবার বলেন, ওঁরাও বা জনজাতিকে বানর নামটি দেওয়া হয়েছিল। যদিও অন্য অনেকের ক্ষেত্রে এটিতে যেন কোন অস্ট্রিক বা নেগ্রিটো জনজাতির কথা বোঝায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্য ( বিশ্ব ভারতী১৪০১) গ্রন্থে সাহিত্য সৃষ্টি প্রবন্ধে লিখেছেন, রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদিগকে দলে লইয়া বহুদিনের চেষ্টায় ও কৌশলে এই দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন,রায় কারণেই তাহার গৌরব গান আর্যদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল।( পৃষ্ঠা ১০৩),১০৫ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন রাক্ষসরা অসভ্য ছিল না। বরং শিল্প বিলাসে তাহার আর্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। বিষ্ফোরক তথ্য দিয়েছেন দীনেশ চন্দ্র সেন।তিনি বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে লিখেছেন, বৌদ্ধ ধর্ম সন্ন্যাসের ধর্ম। এরই প্রতিশোধ হিসেবে গ্রাহস্থ্য ধর্মের রামায়ণ।হনুমানের জন্মস্থান নিয়ে শুধু বিতর্ক নয়, মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত।অন্ধ্রপ্রদেশের দাবি হনুমানের জন্ম তিরুপতির অঞ্জনাদি পর্বতে। আবার কর্ণাটকের মানুষের বক্তব্য, কিষ্কিন্ধায়হনুমানের জন্ম । এই অঞ্চল কর্নাটকে। আবার মহারাষ্ট্র ., গুজরাট , ঝাড়খণ্ড ও উত্তরাখণ্ডও দাবি করে তাঁদের রাজ্যে হনুমানের জন্ম। আদালতে রাম মন্দিরের রায়ের সঙ্গে হনুমানের জন্মস্থান নিয়ে রায় দেয় আদালত।সেখানে কর্ণাটকের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন শেষ করব দক্ষিণের সমাজকর্মী পেরিয়ারসামীর বক্তব্য দিয়ে।তিনি লিখেছেন হনুমান অন্যায়ভাবে লঙ্কানগরীকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অগ্নিকাণ্ডে বহু অসহায় মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ও লঙ্কানগরী এক মৃত্যু নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সীতার সঙ্গে কথাবার্তার সময় তিনি অনেক নির্লজ্জ ও অসভ্য উক্তি করেছিলেন। সীতার সামনে তিনি পুরুষের লিঙ্গের বিষয়ে কথা বলে সীতাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন।,( সুন্দর কাণ্ড,৩৫ সর্গ) এই তথ্যের সত্যতা জানতে পাঠক ডুংরি প্রকাশনার সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অনূদিত পেরিয়ারের সত্য রামায়ণ ও অন্যান্য রচনা গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। শেষ হইয়াও হইল না শেষ। যদি মা বলা হয় রামের আত্মহত্যার পর রামচন্দ্র সবাইকে নিয়ে বোস্বর্গে ফিরে গেলেন। দলে কিন্তু ছিল না হনুমান। কারণ রামের পুত্রদ্বয় লব ও কুশ তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক। ফলে তাঁদের অভিভাবক হিসেবে থেকেযান হনুমান। রামের পুত্রদের হয়ে রাজ্য বিজয়ের জন্য বহু যুদ্ধও করেছেন। শেষে হিমালয়ে চলে যান তপস্যার জন্য। পুরাণ অনুযায়ী হনুমান আজও বেঁচে আছেন। ( শেষ)