সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: সি এ এ প্রসঙ্গে প্রয়োজন বাঙালির ইতিহাস চর্চা। পর্ব ৮ এ জানিয়েছি সিরাজদ্দৌলার কথা। এরপর স্বদেশী দালালদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলা কিভাবে ইংরেজের দাস পরিণত হল কমবেশি সবাই বিষয়টা জানেন। সিএ এ আর এন আর সি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কেন এত উদগ্রীব সেটা জনগণকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিল রাজ্যের বিরোধী দলগুলি ও বুদ্ধিজীবীদের। দায়িত্ব বর্তায় দেশের অগ্রণী প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়াগুলির। কিন্তু সকলেই ভাসা ভাসা কথা বলছেন। কিছুটা অজ্ঞতা কিছুটা রাষ্ট্রকে ভয়। সি এ এ ও এন আর সি ফাঁদে প্রথমে পড়েন অসমের মানুষ। ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চ বর্ণের মানুষদের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।হিন্দু মুসলিম বিভেদ, উচ্চ বর্ণ বনাম তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষদের মধ্যে বিভেদ,ভূমিপুত্র অহিন্দুদের তালেগোলে হিন্দু বানিয়ে তাঁদের ওপর কর্তৃত্ব । মতুয়া সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মে জয় শ্রী রাম বলার প্রথা নেই। অনেকে মনে করেন মতুয়ারা যখন হরি ধ্বনি দেন বেসেটা বুঝি বিষ্ণু ভগবানের উদ্দেশ্যে। আসলে মতুয়ারা হরি দেয়নি দেন তাঁদের ভগবান হরিচাঁদ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে।
বিজ্ঞাপন
নিম্নবর্ণের অবস্থানে থাকা নীতীশ বিশ্বাস তাঁর ভারতে বাঙালি উদ্বাস্তু বইতে লিখেছেন, ব্রিটিশ যেমন এদেশে তাদের ক্ষমতা প্রলম্বনের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শিকড় দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য একদিকে ধর্ম আর অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে নানা সুযোগ ও প্রলোভন চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেশের জন্য যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হলে নিজের ভাষায় সর্বোচ্চ স্তরে তার বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারবেন।,,,,, গান্ধির প্রিয়তম নেহরু বামপন্থীর লাল গোলাপ খচিত জোব্বা শেরওয়ানি কোর্ট পড়লেন আর প্যাটেলকে লৌহমানব সংজ্ঞা দিয়ে দেশভাগের শিক্ষণ্ডি করলেন গান্ধিজী। অন্যদিকে বাংলার বর্ণবাদী হিন্দু নেতৃত্ব দেখলো বাংলা এক থাকলে এরাজ্যে শুদ্ররাজ হবে।মুখ্যমন্ত্রী হবেন ফজলুল হক, যোগেন মণ্ডল, বীরেন শাসমল বা শক্তি সরকারদের কেউ।তাই তাঁরা বাংলা ভাগে মদত দিলেন। বাঙালি বাঙালি বলে আজ কলকাতার ভোট ভিক্ষুক বর্ণ হিন্দু নেতাদের কুম্ভিরাশ্রুর তলায় তাই কোন সার পদার্থ নেই। বহুদিন আগেই হীনস্বার্থে মনুবাদের কাছে তারা নত হয়েছিল। যেমন ন্যুব্জ হয়ে গিয়েছিল ইংরেজ দাসত্বের কাছে। সে মেরুদন্ড আর সোজা হয়নি। বিধান রায়কে তাই যতই পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বলা হোক, আসলে তিনি বাঙালি উদ্বাস্তুদের নানা মুখী সর্বনাশের নেপথ্য নায়ক। ভারতীয় সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে বাংলার ভাষা চিন্তা, সংস্কৃতি চিন্তা , দেশভাগ, রবীন্দ্র প্রেম সর্বত্র এই বর্ণ স্বার্থ শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হয়েছে, তাই নেতাজির দাদা শরৎ বোসদের বাংলা ভাগের বিরোধিতা ধোপে টেকেনি- জয়ী হয়েছে বাংলা ভাগপন্থী সামন্ততান্ত্রিক কংগ্রেস , মুসলীম লীগ, হিন্দু মহাসভার বাঙালি নেতৃত্বই অন্য রাজনৈতিক দলেরও তাতে ছিল সহযোগ। ( পৃষ্ঠা ৮/৯)
সেই সূত্র ধরেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানুষদের পায়ের নিচে রেখে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে শুধু পেট চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দাস বানানোর প্রথম পদক্ষেপ সি এ e ও এন আর সি। জেনে রাখা দরকার সি এ বি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির শুনানিতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ( আই বি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ তে পাকিস্থান , বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে অমুসলিম অভিবাসীর সংখ্যা হল ৩১৩১৩ এবং এরা সকলেই এসেছেন ২০১৪ র ডিসেম্বরের মধ্যে। সংক্ষেপে বলা যায়, সি এ এ তে প্রস্তাবিত উপভোক্তাদের অধিকাংশ ইতিমধ্যেই ভারতে বসবাস ও উপার্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পেয়ে গেছেন, পেয়েছেন প্যান কার্ড, আধার কার্ড ,ড্রাইভিং লাইসেন্স, এমনকি তাঁদের পরিবারের জন্য তাঁরা বাড়ীও কিনেছেন। এই বক্তব্য ২০২০ বিশেষ জানুয়ারি সংখ্যা দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদকীয় দফতরের। পশ্চিমবঙ্গ ভোটার তালিকায় ৩০ শতাংশ মুসলিম । বাইরে থেকে আরো কিছু হিন্দু ও অহিন্দু ও অমুসলিম দের নাগরিকত্ব দিয়ে, অনুপ্রবেশ করে আসা বাঙালি মুসলিমদের আধার কার্ড কেড়ে বেনাগরিক বানিয়ে ভোটের ভারসাম্য আনা।বাংলার ক্ষমতা দখলের জন্যই এই পরিকল্পনা। মুসলিমদের একটা অংশকে বেনাগরিক করার অর্থ তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। বিষয়টি কিন্তু মনগড়া নয়। অসমে এন আর সি তৈরির সময় ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষকে তালিকা থেকে নাম বাদ বেদেওয়ায় তাঁরা খাতাকলমে অনুপ্রবেশকারী হয়ে আছে। এঁদের স্থান ক্যাম্পে। আমৃত্যু পেট চুক্তিতে খাওয়া পড়া মিলবে ক্যাম্পে থেকে।থাকবে না ব্যাংকে টাকা রাখার অধিকার।ক্যাম্প মানে একধরনের জেল। শুভেন্দু অধিকারী , শান্তুনু ঠাকুর মতুয়াদের ভুল বোঝাতে পেরেছেন এক অংশে। আরেক অংশ চালাকি টা ধরে বলতে শুরু করেছেন নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চাই। কিন্তু সেটা কেন্দ্রীয় সরকার দেবে না।কাল রবিবার শেষ পর্বে বিষ্ফোরক এক তথ্য দিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন শেষ করব।( চলবে)
বিজ্ঞাপন