বাংলায় শিবের পুজো শুরু সেন সাম্রাজ্যে
পর্ব: ৫
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বাংলায় শিবের পুজো শুরুর ইতিহাসে চোখ রাখা যাক। বৌদ্ধধর্মের বিদায় পর্ব সেনবংশের আমলেই পরিণতি পায়। সেনবংশের আরাধ্য দেবতা ছিলেন শিব। দক্ষিণ ভারতে অনার্য সংস্কৃতিতে শৈবপন্থীদের ছিল প্রভাব। সেনবংশের রাজা বল্লালসেন ও লক্ষণসেনও ছিলেন শৈবপন্থী। পরে লক্ষণসেন বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো। এখন দেখবো সেনবংশের শাসনে শৈবধর্মের বিকাশ।
আগেই বলেছি,বৈদিক ধর্মে কিন্তু এই অনার্যদেবতা শিব অর্থাৎ লিঙ্গ পূজাকে ইতর রীতি বলা হয়েছে। আছে নিন্দাসূচক বিশেষণ। অনার্য এই দেবতাকে হিন্দু ধর্মে বলা হয় তামসিক দেবতা। গাঁজাসেবনকারী ভূত _প্রেত যাঁর সহচর, অর্ধনগ্ন দেবতা,অশুভ। কিন্তু যত হিন্দুধর্মের প্রসার বেড়েছে তত আর্যগোষ্ঠী বোঝে,ভূমিপুত্রদের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে হিন্দু আধিপত্য বিস্তার সম্ভব নয়। দলে সমঝোতার পথে যেতে শিবকে বৈদিক দেবতা রুদ্রের স্থান দেওয়া হয়। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু দেবতার পাশে স্থান দিয়ে ত্রিদেব তত্ব প্রচার শুরু হয়।
শিব শব্দের উৎপত্তি শী ধাতু (শয়ন) থেকে। সবার মধ্যে যিনি শায়িত। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল। যা কিছু মঙ্গলময় তাই শিবস্বরূপ। শিবের আরেক নাম শম্ভু।শম্ভু মানে কল্যাণ। যিনি কল্যাণকর তিনি শিব শম্ভু।শিবকে বলা হয় যিনি নিজে নিজেকে সৃষ্টি করেন।তাই তাঁকে বলা হয় স্বয়ম্ভু । ভারতের নানা প্রান্তে শিব নানানামে পরিচিত। বিহারে শিব বৈদ্যনাথ নামে পরিচিত। সুস্থ দেহে ও মনে জীবনধারণের রহস্য যাঁর করায়ত্ত,তিনি বৈদ্যনাথ। শিবের মূর্তি পরিকল্পনাতে ও আছে বিভিন্ন অর্থের রূপক। অনার্য ভারতের ভূমিপুত্রদের দলপতি হিসেবে শিব প্রতিষ্ঠিত। আদিম জনগোষ্ঠীর দেবতা। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার ভূমি খনন করে প্রতত্নবিদেরা কিছু সিলমোহর আবিষ্কার করেছেন। যেখানে জন্তুবিশেষ পরিবেষ্টিত যোগাসনে উপবিষ্ট কিছু প্রতিকৃতি মেলে যাকে আদি শিব বা
বিজ্ঞাপন
পশুপতি বলা হয়েছে। আর্য আগ্রাসনে সিন্ধুতট ছেড়ে অনার্য ভূমিপুত্ররা ক্রমশ দক্ষিণ প্রান্তে অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ভারতে বসতি নির্মাণ করেন। সিন্ধু উপত্যকায় অনার্যদের উপাস্য দেবতারা ছিলেন মূলত নারীনির্ভর। পুরুষ দেবতা একমাত্র শিব। পশুপতি হিসেবে পরিচিত এই দেবতার সহচর হাতি, বাঘ, গন্ডার ও মহিষ। তাই বোধহয় অনার্য মহীশূরের মহিষাসুরের সঙ্গে মহিষের এক সম্পর্ক থেকে গেছে। অনার্য বাঙালির পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে বধ করছেন আর্য দেবতা দুর্গা। সে দুর্গার উপাসনায় বাঙালি। এও কি বাঙালির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত? তাই বুঝি ভারত জুড়ে অনার্য অসুর সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা শিব। থাক এই প্রসঙ্গ। ফিরে যাই দক্ষিণ ভারত থেকে আগত লক্ষণসেনের শৈবধর্মে বিশ্বাস প্রসঙ্গে।
অনার্য সমাজে শিবের উৎপত্তি মূলত পশুপালনের দেবতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে খান্ডবা নামে এক স্থানীয় দেবতার কথা। যাঁর রূপ পরিকল্পনাঅনেকটাই শিবের মত। শিবের বাহন ষাঁড়। এই পশুটি শক্তি,আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ষাঁড়মূর্তি প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু হিসেবে মিলেছে। শিব কৈলাশপর্বতনিবাসী।গ্রীক দেবতা দেবরাজ জিয়াস অলিম্পাসপর্বতনিবাসী।মহাদেবের কন্যা মনসা , তেমন জিয়াস কন্যার এথেনা।
প্রশ্ন উঠতে পারে , পাশুপত তথা শৈব ধর্ম আগে না বৌদ্ধ ধর্ম?, উত্তর মিলবে মহাভারতের রচনাকাল ধরলে। মহাভারত রচিত আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত। মহাভারতের শান্তি পর্ব লিখিত হয়েছে বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েকশো বছর পর। ফলে পাশুপত ধর্মে বুদ্ধের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সেনবংশের আগমন কর্ণাটক থেকে । দক্ষিণ ভারতে আদি পাশুপত ধর্ম বিবর্তনে অনেকগুলি শৈব ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।যেমন নায়নার, শৈব সিদ্ধান্ত, আগমান্ত, বীর শৈব বা লিঙ্গায়েত গোষ্ঠী। বাংলাতেও হীনযান বৌদ্ধদের প্রভাবে বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবী হিন্দু ধর্মে কালী দেবী এবং দক্ষিণী হিন্দু প্রভাবে শিব স্বামী স্ত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ঈশ্বরবিরোধী বৌদ্ধধর্ম কালের স্রোতে মূর্তি বিশ্বাসী দেবী উপাসক সহজিয়া বৌদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গদেশে নিজস্ব একটি ধারা তৈরি হয়ে যায় পাল বংশের আমলেই । এরপর বৌদ্ধধর্ম যত অস্তমিত হয়েছে তত বঙ্গদেশে শিব ও কালী তন্ত্রমতে প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে লক্ষণসেন বৈষ্ণব হয়েছেন স্বাভাবিক বৈষ্ণবতন্ত্রের আগ্রাসনে। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বুদ্ধদেবের ছায়ায় শিব প্রতিষ্ঠিত হলেন বাংলায়। বাংলায় শিবরাত্রি অর্থাৎ শিব চতুর্দশী এবং চৈত্র সংক্রান্তির গাজন শৈবধর্মের প্রধান উৎসব জনপ্রিয়।
শিবরাত্রির ব্রত প্রধানত বাংলার মেয়েরা করে আসছে। ব্রত শব্দটি ব্রাত্য থেকে এসেছে। ব্রাত্য জনের উপাসনা। সে যুগে মেয়েরা সমাজের ব্রাত্য ছিল। আর্য সমাজেও শিব ছিলেন অনার্য ব্রাত্য দেবতা। লক্ষণসেনের শৈব ধর্ম ছেড়ে বৈষ্ণব হওয়ার ক্ষেত্রে নতুনত্ব কিছু ছিল না। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস(আদি পর্ব) গ্রন্থে বলেছেন, বাংলাদেশে সর্বতোভাবে আর্যিকরণ আরম্ভ হয়েছিল গুপ্তপর্বেই। ভারতের ইতিহাসে আমরা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তার পরবর্তীকালের বহু রাজাই বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। শৈব ধর্ম প্রভাবিত দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটে। এডওয়ার্ড ওয়াসবার্ন হপকিন্স তাঁর ‘দ্য রিলিজিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, বৈষ্ণব ধর্মের বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। কৃষ্ণ ধর্মের উৎপত্তি অনেক পরে। প্রথমে যা ব্রাহ্মণ্য সমাজে স্বীকৃতি পায়নি। পরে বিষ্ণুদেবের অবতার হিসেবে কৃষ্ণকে যুক্ত করে নেওয়া হয়। প্রধান কারণ, দেশের সর্বত্র ব্রাহ্মণ সমাজে যাতে স্বীকৃতি মেলে। রামায়ণ আর মহা ভারতে রামচন্দ্র ও কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই আর্য আগ্রাসন আরও সাফল্য পায়।বাংলায় কিন্তু তখনও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে শাক্ত ধর্ম প্রধান ধর্ম।কৃষ্ণস্তুতি বঙ্গে অনেক পরে চৈতন্যদেবের প্রচারে জনপ্রিয়তা পায়। সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো।বাংলায় দ্রাবিড়যোগে সৃষ্টি হওয়া অবৈদিক ব্রাহ্মণদের মধ্যে শাক্ত ধর্ম একদিকে যেমন প্রভাবিত তেমন সাধারণ বাঙালিদের মধ্যেও শাক্ত ধর্ম প্রভাবিত হতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
অনার্য ভারতে শক্তি পূজা মোটামুটি তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল।১) কাশ্মিরী সম্প্রদায়,২)দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রদায় ৩)বঙ্গীয় বা গৌড়ীয় সম্প্রদায়। কাশ্মিরী তন্ত্রে দেবী সারদা, দক্ষিণ ভারতে পূজিতা শ্রীবিদ্যা , লোলিতাদেবী,বঙ্গীয় সম্প্রদায় দশ মহাবিদ্যাতন্ত্র নির্ভর। শাক্তমতের তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু যৌনউদ্দীপক আচার আচরণের দোহাই দিয়ে শাক্ত ব্রাহ্মণরা ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়ে সমাজকে কিভাবে কলুষিত করতে থাকে এবং সেই সময়ে চৈতন্যদেবের উত্থান কি ভাবে হয়,তিনি কিভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন সেই প্রসঙ্গে আর কয়েক পর্ব পরে আলোচনা করবো। এই পর্বে আমরা দেখবো শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পাশাপাশি লোকায়ত বিশ্বাসগুলিও সাধারণ মানুষের মধ্যে একাত্ম হয়েছিল।এই লোকায়ত বিশ্বাস কিন্তু মোঘল যুগ পেরিয়ে ব্রিটিশ যুগেও ছিল। ব্রাহ্মণ্য শ্রেণী শাসককূলের অনুগ্রহ পেতেন। কিন্তু লোকায়ত ধর্মের জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করার সাহস ব্রাহ্মণ বা শাসকদের ছিল না। তাই লোকায়ত দেবতারা শৈবধর্মে সুকৌশলে ব্রাহ্মণদের চাতুর্যে মিশে গেল।ফলে সমাজের ওপর স্তরে যেমন বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণ ও গীতা , বেদ আধিপত্য বিস্তার করেছিল তেমন সমাজের মধ্যবর্ণ ও নিম্নবর্ণমহলে শিব প্রতিষ্ঠিত হন। ধীরে ধীরে বাংলায় পূজার সঙ্গে হাজার আচার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়।
আহ্নিক, প্রার্থনা ও পূজার পাশাপাশি দশ সংস্কার যেমন_ নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ অর্থাৎ মাথা ন্যাড়া,কান ফুঁটো করা , উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, পুংসবন(গর্ভ ধারণের তৃতীয় মাস অনুষ্ঠান), সীমন্তন্নয়ন (চতুর্থ, ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসেরগর্ভধারণের অনুষ্ঠান ) ও জাতকর্ম অর্থাৎ পুত্র জন্মের অনুষ্ঠে়য় কর্ম প্রভৃতি। এছাড়াও বাঙালি অঞ্চলভেদে আরও কিছু ঐচ্ছিক অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হয়। যেমন বিভিন্ন ব্রত, নববর্ষ উৎসব, জামাইষষ্ঠী, রথযাত্রা, অম্বুবাচী, ঝুলনযাত্রা, রাখিবন্ধন, নষ্টচন্দ্র, হোলি ও দোলযাত্রা, চড়ক পূজা প্রভৃতি। এছাড়া আরও প্রায় ১০১ টি আচার অনুষ্ঠান বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত হয়। যেমন, অধিবাস, অন্ত্যেষ্টি, অশৌচ,আকাশ_প্রদীপ, একাদশী, কালবেলা, জপ, তর্পণ, দক্ষিণা, দীক্ষা, নবান্ন, প্রায়শ্চিত্ত, মহালয়া, রাসযাত্রা, সংক্রান্তি, হবিষ্য ও হাতেখড়ি প্রভৃতি। বাঙালি হিন্দুরা এই আচার প্রথাকে ধর্ম হিসেবেই মানে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,(কালান্তর: বিশ্বভারতী: কলকাতা ১৪০০)এই গোঁড়ামির শুরু হিন্দু যুগে। হিন্দু যুগ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার যুগ। কারণ এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল।,,,,,( সিন্ধু থেকে হিন্দু, ড: আর এম দেবনাথ, প্রকাশক রিডার্স ওয়েজ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৭২)। আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জাতিভেদ প্রথাও ক্রমশ বেড়ে ওঠে।( চলবে)