শ্রীজিৎ চট্টরাজ: জাতিসংঘের সমীক্ষায় ২০২৪ সালে বিশ্বে প্রায় ১৩১ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন। এঁদের মধ্যে ৬৩ মিলিয়ন দেশেই উদ্বাস্তু হবেন।৫৭ মিলিয়ন হবেন বহিরাগত ভাবে বাস্তুচ্যুত। এই তালিকায় ৫০ শতাংশ নারী ও শিশু। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার জানিয়েছে, সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন ও পুঁজিবাদী উপনিবেশ তৈরির ফলশ্রুতিতে এই উদ্বাস্তু সমস্যা প্রতিদিন বাড়ছে। করোনা প্রবাহের পর ২০২২ সালেই বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০৮.০৪ মানুষ। যাঁদের ৩৫.৩ মিলিয়ন শরণার্থী। ভারতে বিশেষ করে বাংলায় উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকার ঘুষপেটিয়া অর্থাৎ উই পোক বিতাড়নের ব্যবস্থা পাকা করেছে সি এ এ আর এন আর সি প্রয়োগে। নতুন করে নাগরিকত্বের পরিচয় দিতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে কারিগর উদ্যাপন এক প্রকাশনা সংস্থার ১৫ তম বর্ষপূর্তিতে একাডেমি মঞ্চে থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম প্রথমবার মঞ্চস্থ করল ঘরের মধ্যে বাড়ি নাটকটি। মঞ্চ, আলো, আবহ, নাটক ও নির্দেশনায় দেবাশিস।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নাটকের প্রথম অভিনয়ে দর্শকের নবসংখ্যা ছিল আশাপ্রদ। নাটকটিতে ছিল দুটি পাঁচ মিনিটের বিরতি। প্রথাগত মঞ্চের পর্দা প্রথা অস্বীকার করা হয়েছে। সম্ভবত রূপক ধর্মী নাটকের মঞ্চসজ্জাও রূপকধর্মী। ফলে মঞ্চসজ্জার সঙ্গে দর্শকদের একাত্মভাব গোর তোলার এক প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। নাটকে একটি মাত্র মানব চরিত্র যাদুকর। বাকিরা আরশোলা , ইঁদুর,টিকটিকি, পিঁপড়ে ও মাকড়সা। এঁদের যৌথ বাস কলকাতার এক পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়িতে। যাদুকর চরিত্রটি মানুষ হলেও জানতে পারা যায় সে এক মৃত চরিত্র।যদিমন্ত্রে তাঁর পুনর্জীবন। এই চরিত্র ঘিরে গড়ে উঠেছে এক রহস্যের কাহিনী। এই বাড়ির বসবাসকারী জীবেরা চিন্তিত । কেননা দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিনে বাড়িটি ভাঙা হবে। বাস্তুচ্যুত হবে মানুষের প্রতিবেশী মাকড়সা, ইঁদুর আরশোলা, টিকটিকি ও পিঁপড়ে। ইতিমধ্যেই এই জীবদের অন্যতম জাল পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করলেও খাদ্য জোটে না। ভাগ্যক্রমে একটি গুবরেপোকা জোটায় মাকড়শার নৈশভোজ সম্পন্ন সম্ভব হয়।বাস্তুচ্যুত জীবদের বাস্তু সংকট আর ঘুষপেটিয়া অর্থাৎ উইপোকা নামে বিভূষিত একদল হতভাগ্য মানুষের জীবনের গল্প মিলেমিশে এক হয়ে যায়। পরিচালকের প্রশংসা প্রাপ্য ইঁদুরের সন্তান প্রসবের দৃশ্যটি নির্মাণ মুন্সিয়ানার জন্য।
বিজ্ঞাপন
বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরে দেখি , আফিমের নেশায় ঝিমাইতে ঝিমাইতে কমলাকান্ত দেখিলেন যে একটি পতঙ্গ সেই সেজটির চারিদিকে বোঁ -ও -ও বোঁ-ও- ও শব্দে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কমলাকান্ত বহু চেষ্টা করিয়াও পতঙ্গের ভাষায় তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে না পারিয়া পতঙ্গের নিকট আপনার অক্ষমতা জ্ঞাপন করিলেন। তখন আফিমের প্রভাবে তাঁহার দিব্যকর্ণ লাভ ঘটিল। দেবাশীসের মানব চরিত্র যাদুকরের অবশ্য মাকড়সা বা আরশোলার গোদা বাংলা কথা বোঝা টা অসুবিধে হয়নি। তবে সহায়ক হয়েছিল বাংলা পানীয়। ফ্রানজ কাফকার বিখ্যাত গল্প মেটামরফোসিস এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল দেবাশিসের ঘরের ভিতর বাড়ি নাটকটি দেখতে বসে। কাফকার গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান। কোনো এক সকালে নিজের ক্লান্ত জীবনের ভাবনা নিয়ে ভাঙা ঘুমে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে নিজেকে একটি বিশাল আকৃতির পোকা হিসেবে আবিষ্কার করে নিজেকে। মানুষ তো কেবল দেশ বা বাসস্থান থেকেই উদ্বাস্তু হয় না। পুঁজিবাদী সমাজে ভোগবাদী সমুদ্রে সাঁতার দিতে দিতেও ভিতরে বাইরে উদ্বাস্তু হয়ে নিজেই নিজের কাছে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। উদ্বাস্তু হয়ে তখন ছুটে বেড়ায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তবে মাকড়সার মুখে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পৃথিবীর ইতিহাসের সংলাপ শুনি। যেখানে হিটলারের নাৎসি ঘটনার সঙ্গে এক পংক্তিতে স্ট্যালিন ও ট্রসকি উপাখ্যান যুক্ত হয়ত একাডেমিতে মঞ্চায়নের সুযোগ মেলার শর্ত।
যাইহোক প্রথমেই যাদুকর চরিত্রের শিল্পী ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়। চৈত্রেরগরমে এমন কায়িক পরিশ্রম করে চরিত্র নির্মাণ অসম্ভব ভালো। ভালো লাগে মাকড়সা চরিত্রে রাজু ধরের অভিনয়। আরশোলা চরিত্রে অনুরণ সেনগুপ্ত ইঁদুর চরিত্রে রায়তী ভট্টাচার্য, টিকটিকি চরিত্রে ডানা রায়, পিঁপড়ে চরিত্রে সায়ন্তন মৈত্র যোগ্য সঙ্গত করেছেন। মঞ্চের পিছনে আলো প্রক্ষেপণ শুভঙ্কর দের নেতৃত্বে। সহযোগী প্রীতম চক্রবর্তী , প্রিয়ব্রত চ্যাটার্জি, সুকুমার দাস ও শুভম বিশ্বাস, আবহ প্রক্ষেপণে শান্তুনু পাল, রূপ সজ্জায় ও পোশাক পরিকল্পনায় ইঁদুর চরিত্রের অভিনেত্রী রায়তী ভট্টাচার্য, ও ব্যবস্থাপনা এবং অভিনয় সহযোগী অপূর্ব ঘোষ, বলরাম রায়, অভিজিৎ সিনহা ও সৈকত , রূপসজ্জা ও মঞ্চ সামগ্রী সৌমজিত দাস, প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ ও অভিনয়ে সৌরভ বারিক , আবহ পোশাক আর নির্দেশনা সহযোগী যাদুকর চরিত্রের অভিনেতা ভাস্কর মুখোপাধ্যায় প্রত্যেকের যৌথ সৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে বাড়ি নাটকটি দর্শকদের তৃপ্ত করবে সন্দেহ নেই। তবে সাংবাদিকদের জন্য রাখা অনেক পিছনের আসনে বসে যতটা সম্ভব নাটকটি নিরীক্ষণ করায় কিছুটা ত্রুটি থেকে গেছে। আসা করি পরিচালক বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবেন।