বেশ্যার বারমাস্যা পর্ব : ২
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন পৃথিবীর আদিমতম পেশা দেহ বিক্রি। কিন্তু কতটা প্রাচীন? ইতিহাস কি বলছে? ইতিহাসে প্রাচীন মিশর , গ্রীক ও রোম সাম্রাজ্যের কথা আছে তেমন আছে ভারতীয় উপমহাদেশের কথা। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মিশেল ও গেন্ডনার মনে করেন, বেদের যুগে ও পরবর্তীকালে বুদ্ধের সময়ে ভারতে পতিতাবৃত্তির চল ছিল। বৈদিক সংস্কৃতিতে বারবধূর সামাজিক সম্মান ছিল। সেযুগে ব্রহ্মচর্যের যেমন প্রথা ছিল তেমনই অবৈধ যৌন সম্পর্কও ছিল। পুরুষের উপপত্নী রাখা আর গোয়ালে গরু থাকাটা ছিল সম্মানের। সমাজে সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের মেয়েদেরও অধিকার ছিল উপপতি রাখার। অথর্বেদে কৌশিক সূত্রে ৩৬/১-৪ বা ৪/৫ কিংবা ৫/৭/১০ সূত্রে পতিতাবৃত্তির উল্লেখ আছে। অভিধান বলছে , পতিত অর্থ পড়ে যাওয়া। স্থানচ্যুত। স্ত্রী লিঙ্গে পতিতা। অর্থাৎ কুমারীত্ব হারানো নারী। কু চরিত্রা । অনেক পুরুষের ভোগ্যা। অনাবাদী চাষযোগ্য জমি। যে জমির কোনো মালিকানা নেই। যে জমিতে যে কেউ কর্ষণ করতে পারে। অর্থাৎ যে নারী জীবনে একক স্বামী নামক প্রভুহীন, বঞ্চিত। তাই পতিতা।
বৈদিক যুগে এক যজ্ঞ হত। নাম মহাব্রু। সেই যজ্ঞের মন্ত্র ছিল অশ্লীল গালাগাল। জীবনের প্রথম নারী সম্ভোগ করত যেসব ছাত্ররা প্রথমে এই যজ্ঞ করত। গোসব যজ্ঞে ( জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ (২/১১৪) যজমান ষাঁড়কে বন্দনা করতেন গাভীদের গর্ভবতী করার জন্য। তারপর একের অধিক নারীকে যৌন সম্ভোগ করতেন। যৌন কামনার তাড়না এমনই ছিল যে নিজের কন্যাকেও ছাড় দেননি প্রজাপতি স্বয়ং। বেদে বলা হয়েছে , প্রজাপতি জীব সমূহের স্রষ্টা, জন্মদাতা ও প্রথম পুরুষ। মনু সংহিতায় ব্রহ্মাকে এই প্রজাপতি উপাধি দান করা হয়েছে। বিয়ের কার্ডে লেখা থাকে প্রজাপতি নমঃ। থাকে প্রজাপতির ছবি । জীবকূলের প্রজাপতির সঙ্গে ব্রহ্মা প্রজাপতির কোনো সম্পর্ক নেই। অজ্ঞতা থেকেই বিয়েতে প্রজাপতি আঁকা হয়। আবার ব্রহ্মার পুত্র হিসেবে মনুকেও প্রজাপতি বলা হয়।
ব্রহ্মার মানসপুত্র দশ ঋষি। মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, ক্রতু, বশিষ্ঠ, দক্ষ, ভৃগু ও নারদ। প্রজাপতি স্বয়ং কন্যা শতরূপাকে শয্যাসঙ্গিনী করেন। পুরাণে শতরূপাকে সরস্বতী বলা হয়েছে। বৈদিক যুগ পেরিয়ে মহাভারতে তাকানো যাক। গান্ধারী অন্তঃসত্বা থাকাকালীন রাজা ধৃতরাষ্ট্র কামনা বাসনা থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন না। তাই এক এক দাসীর সঙ্গে সম্ভোগে পুত্র যুযুৎসুর জন্ম দেন। আদি মহাভারতের ১১৫/৩৯ শ্লোকে উল্লেখ আছে। যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন। হ্যাঁ সেযুগে দাসীর শ্রমদানের সঙ্গে দেহদানের অঙ্গীকার করতে হত মালিকের কাছে। মৎস্য পুরাণে ২২৭/১৪৭ বিধানে বলা আছে কোনো দাসী দেহদানে অস্বীকৃত হলে তার প্রাপ্য বেতনের দ্বিগুণ দণ্ড দিতে হত। ভাগবত পুরাণ অনুসারে ১/১১/২০ শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাপুরীতে প্রথম রাজা হিসেবে পদার্পণ করলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর তালিকায় ছিলেন দ্বারকার শত শত গণিকা।
ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রকাশিত সঙ্গীতা চৌধুরীর একটি প্রতিবেদন পুন:মুদ্রণ করেছে স্বদেশ চর্চা লোক পত্রিকা। লেখিকা লিখেছেন জিডিও গণিকাবৃত্তি নগরজীবনেরই অঙ্গ, তবুও ঋগ্বৈদিক – এর সন্ধান মেলে সে যুগেও এক ধরন বা বিস্তৃতি সম্বন্ধে খুব সঠিক তথ্য নেই। তবে ঋগ্বেদেই প্রথম বিশ্যা কথাটির উল্লেখ পাই, যার অর্থ একজন মহিলা যার গৃহে সকল পুরুষের আনাগোনা। তবে বেদে আছে ভাগ্যহীন অরক্ষনীয়া মেয়েরা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হত। পুংশ্চলি ও মহানগনী নামে দুটি বেদের বিভিন্ন শাখায় পাওয়া যায় যেগুলি সম্ভবত গণিকাদের নাম বলেই মনে হয়। অথর্ব বেদে আছে যে গ্রামীণ নৃত্যের সময়ে মহিলাদের গন্ধর্বরা ভোগ করতেন। বৈদিক সাহিত্য অনুসারে ক্রীতদাসীরাই পতিতা হিসেবে ব্যবহৃত হতেন। সাঙ্খ্যায়ন আরণ্যক ও বাজসনেয়ী সংহিতায় এই পেশার উল্লেখ আছে।
বাংলার সংস্কৃতিতে গণিকা ভজনার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। দোলে, রাসে , জমিদার বাড়িতে দুর্গাপূজা উৎসবে গণিকা সঙ্গ ছিল অপরিহার্য। সেই বাবু কালচারের যুগে বেশ্যা, ভৃত্য ও ইয়ার বন্ধুদের সাথে কলকাতার কাছাকাছি কোনো বাগানবাড়িতে পাক বিধি কার্য ছিল সম্মানের। দেওয়ান কার্তিকচন্দ্র রায় লিখেছেন, পূর্বে গ্রিস দেশে যেমন পণ্ডিত সকল বেশ্যালয়ে একত্রিত হইয়া সদালাপ করিতেন, সেইরূপ এখানেও প্রচলিত যাঁহারা ইন্দ্রিয়াসক্ত নহে, তাঁহারাও নিমিত্ত এই সকল গণিকালয় যাইতেন। সন্ধার পর রাত্রি প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয় পরিপূর্ণ থাকিত। এশিয়ার সবচেয়ে বড় বেশ্যাপল্লী উত্তর কলকাতার সোনাগাছি।
এখানকার ৪৩ টি বাড়ির মালিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। ইংল্যান্ড থেকে যে অবিবাহিত কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে যেসব অবিবাহিত যুবকেরা আসত তাদের জন্য বেশ্যাপল্লীর ব্যবস্থা করেন বেনিয়া দ্বারকানাথ ঠাকুর। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই সমাচার দর্পণ ও ভবানীচরণের লেখার সূত্র অনুসরণ করলে দেখা যায় , বাগানবাড়িতে বাবু যেতেন ১) বাঁধা বেশ্যা ২) বিক্রি হওয়া গরীব মেয়ে,৩) গরীব ঘরের বিধবা,৪) অনুঢ়া কন্যা, অবিবাহিতা অথচ বয়স্ক রমণী ৫) সম্ভ্রান্ত ঘরের স্বামীবিচ্ছিন্না ও স্বেচ্ছাচারী নারী ৬) ফুঁসলিয়ে আনা আত্মীয় স্বজন বা নিজের বোনও ৭) জোর করে ধরে এনে ধর্ষণ করে সমাজে ছেড়ে দেওয়া মেয়েদের। এইসব মেয়েরা অনেক সময় গ্লানি ও লজ্জায় আত্মহত্যা করত। কেউ কেউ অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে গণিকাপল্লীতে গিয়ে জীবন শুরু করত কেউ নিজেই ব্যাবসা খুলে বসত। আজ সেই আদিম পেশাকে কর্পোরেট লুক দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় রয়েছে দ্য এলিয়েন ক্যাথ হাসু । এখানে ফ্ল্যাট বাড়িতে ভরপুর যৌনানন্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আমেরিকার সংবাদসূত্র বলছে, ৭৫ বছর বয়সী দুইবোন আমেরিকান যৌনকর্মী মার্টি ও লুই ফেকনস জীবনের ২০ বছর বয়সে পেশায় আসেন । ৫০ বছরে দুজনে ৩ লাখ ২৫ হাজার পুরুষকে সঙ্গ দিয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ৯ জন পুরুষকে তৃপ্ত করেছেন। তবে এটাও মনে করার কারণ নেই যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা বাধ্য হয়েই দেহ বিক্রি করে। ভোগবাদী দুনিয়ায় জীবনের চাহিদা মেটাতে পড়াশুনোর খরচ চালানোর আবেগ বার্তা ছড়িয়ে অনেক মেয়েই পয়সা ফেকো তামাসা দেখো মতবাদে বিশ্বাসী।২১ শতাব্দীতে বহু মেয়ে কুমারীত্ব বিক্রি করছে চড়া দামে। যেমন রাশিয়ান মেয়ে নতলি দাইলান।২২ বছর বয়সে ৩.৭ মিলিয়ন ডলারে কুমারীত্ব বিক্রি করেছেন। আরেক রাশিয়ান ললনা আরিয়ানা ও তাঁর বান্ধবী ললিটা ৪ লক্ষ ডলারে বিক্রি করেছেন । এক লক্ষ ডলারে ক্যাটরিনা মিগলিওরিনি শরীর বেচেছেন এক ব্যবসায়ীকে। রোমের তরুণী পোলিনা পার্সিয়া ১৪,৯৮০ ডলারে এক পাঁচতারা হোটেলে মধ্যবয়সী ধনীর হাতে তুলে দিয়েছেন নিজের কৌমার্য। সাইবেরিয়ার নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে শতুনিহা ইন্টারনেটে ৩২ হাজার ডলার হেঁকে নিজের কুমারীত্ব বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন । বিস্তর দরাদরির পর ২৭,৯৫০ ডলারে দেহ তুলে দেন এক নারীদেহের সওদাগরকে। পেশায় চিকিৎসক ডাঃ এলিজাবেথ রেইন।
নারী স্বাধীনতা ও নারী শিক্ষার জন্য তহবিল গড়তে ৮ লক্ষ ১ হাজার ডলারে কানাডার এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর শয্যায় নিজের কুমারীত্ব নিলাম করেন। গতবছরের কথা, প্যারিসের বাসিন্দা জেসমিন সিন্ডারেলা এসকর্ট নামের একটি সংস্থার সোশ্যাল পেজে নিজের যৌন আবেদনমূলক ছবি বিজ্ঞাপনদিয়ে নিজের কুমারীত্বের দাম রাখেন ২ লক্ষ ইউরো। কারণ সুখী হতে টাকার দরকার। তাঁর যুক্তি একদিন নএকদিন বিয়ে করলে শরীরটা দিতে হত স্বামীকে। কিন্তু সেই স্বামী পরবর্তী জীবনে সুখী করতে পারবেন কিনা তার গ্যারান্ট কি? তাঁর ইচ্ছে বিশ্বভ্রমণ ও বড় একটা ব্যাবসা করা। নিলামে জেসমিনের কুমারীত্ব উপভোগ করার জন্য দর হাঁকেন ৯ লক্ষ ইউরো। তার আগে এক জার্মান রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী দর দেন ৬ লক্ষ ইউরো। কিন্তু ১০ লক্ষ ইউরো দর দিয়ে জেসমিনের কুমারীত্ব কেনেন নিউ ইয়র্কের এক ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকার। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে জেসমিন বুঝে নিতে চেয়েছিলেন সেই প্রথম রাত উপভোগের হবে না কি যন্ত্রণার। কিন্তু প্রথম আলাপেই গ্রাহকের প্রেমে পড়ে যান জেসমিন। যদি সম্পর্ক পরে ভেঙ্গেও যায় তাহলে অর্জিত টাকা দিয়ে নিশ্চিত জীবন কাটাতে পারবেন জেসমিন। তবে এই যুক্তি যদি মেয়েরা বেশি পরিমাণে অনুপ্রাণিত হন তবে বিবা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখ পড়বে বলাই যায়।( চলবে)