শৈবপন্থীদের গোষ্ঠীবিভেদ | পর্ব : ৪
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: হিন্দু ধর্মের পাঁচটি শাখা। সৌর, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ও গাণপত্য। সৌর উপাসকেরা সূর্যের উপাসক। শৈব শিবের উপাসক। শাক্ত কালীর উপাসক। বৈষ্ণব বিষ্ণুর উপাসক ও গাণপত্য গণেশের উপাসক। অঘরিপন্থী শৈব সম্প্রদায়ের পোশাকের রং কালো। অঘরি শব্দের অর্থ ভয়হীন। উত্তর ভারতের এই সম্প্রদায়ের কাপালিক ধারার অঘরিরা যে পাত্রে মদ বা জল খান সেটি মরদেহের খুলি। বলা হয় মহাপাত্র। অঘরি শৈবপন্থী। তাঁদের আরাধ্য দেবতা অঘোরা। শিবেরই এক রূপ। বিশ্বাস, যিনি গুজরাটের গিরনা পর্বতের ওপর বাবা কীনা রামের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবান দত্তাত্রেয় সেই তরুণ তপস্বীকে নিজের মাংস অর্পণ করে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এঁদের কুল দেবতা কালী । তবে সেই দেবীর নাম হিংলাজ। যে তীর্থ এখন পাকিস্থানের বালুচিস্থানের পাহাড়ে। বাংলায় উত্তম, সুচিত্রা বিকাশ রায়কে নিয়ে মরুতীর্থ হিংলাজ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
বিজ্ঞাপন
অঘরি বিষয়টি বুঝতে আগে তন্ত্র বিষয়টি জানা দরকার। তন্ত্র শব্দের অর্থ বিধি। তন্ত্রের বিস্তারিত জানার আগে শৈবপন্থীদের গোষ্ঠী কি কি জানা যাক। যুক্তিবাদী প্রয়াত প্রবীর ঘোষ তাঁর অলৌকিক নয় লৌকিক গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডের শৈব ধর্ম ও তন্ত্র শিরোনামে এক অধ্যায়ে লিখেছেন দক্ষিণ ভারতে শৈব ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। এখান থেকেই কিছু শৈব মতবাদ উঠে এসেছিল। নায়নার এমনই এক শৈব সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় শৈব ধর্মের উপর বহু গ্রন্থ ও হাজার হাজার শ্লোক রচনা করেছেন। পেরিয়াপুরাণম গ্রন্থে নায়নার সম্প্রদায়ের ৬৩ জন শৈব সাধকের জীবনী লেখা আছে। গ্রন্থটি পড়ে বোঝা যায় নায়নার শৈব সম্প্রদায় জাতপাত মানত না। কারণ এই ৬৩ জন সিদ্ধ পুরুষদের মধ্যে ব্রাহ্মণ থেকে পতিত জাতির মানুষ সবই আছেন। তামিল সাহিত্যে ভক্তিবাদের প্রচলন ও প্লাবন আসে নায়নার সম্প্রদায়। শৈব সিদ্ধান্ত দক্ষিণ ভারতের আর একটি শৈব সম্প্রদায়ের নাম। এঁরা ছিলেন চূড়ান্ত ভক্তিবাদী। এঁদের মতে যোগ জ্ঞান দ্বারা পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটানোর পথ যথেষ্ট কঠিন। তার চেয়ে অনেক সোজা চর্যা মার্গের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা বা ঈশ্বর লাভ। সাধকের জীবনচর্যাই হবে এমন যে সে নিজেকে শিবের অনুচর ভৃত্য বলে মনে করবে। দক্ষিণ ভারত থেকেই উঠে এসেছিল আরও একটি শৈব ধর্মীয় সম্প্রদায়। নাম আগমান্ত শৈব ধর্ম। এই সম্প্রদায় মনে করে আগম শাস্ত্র অপৌরুষেয়। এগুলো স্বয়ং শিব তাঁর পঞ্চ মুখে বর্ণনা করেছিলেন। আগমশাস্ত্র আসলে তন্ত্র শাস্ত্রেরই একটা ধারা। এই সম্প্রদায় অষ্টযোগ প্রক্রিয়ার দ্বারা নানা অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করার কথা বিশ্বাস করে। ওঁরা বিশ্বাস করেন মানুষের দেহে ষটচক্রের অবস্থানে। বিশ্বাস করেন, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে মাথার খুলির নিচে থাকা সাপ ফণা গুটিয়ে নেবে। এই সাপই মহাশক্তি। পদ্মের বীজেই রয়েছেন স্বয়ং শিব। শৈব ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রগতিশীল সম্প্রদায় হল বীর শৈব বা লিঙ্গায়েত। এই সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ ছিলেন কন্নড় ব্রাহ্মণ বাসব। বাসব ছিলেন চালুক্যরাজ বিজ্জলেরঅত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী। চেয়েছিলেন কর্ণাটক থেকে জৈনদে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে শৈব ধর্মকে সংস্কার করে প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি একদিকে যেমন প্রকৃতই ধর্ম সংস্কারকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার একদিকে তেমন- ই জৈন ধর্মকে কর্ণাটক থেকে উৎখাত করে ছেড়েছিলেন। বাসবের এই বীর শৈব বা লিঙ্গায়ত রা জাতপাত ও নারী পুরুষের ভেদাভেদে বিশ্বাস করে না। বাসব স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের বুদ্ধি ও পদমর্যাদাকে ব্যবহার করেছিলেন।
নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন নকশিকাঁথা পত্রিকার সম্পাদক প্রভাত ঘোষ। তিনি পত্রিকার সাধু সমাজ ভাবনা সংখ্যায় নাগা সন্ন্যাসীর মুখোমুখি প্রবন্ধে সাক্ষাৎকার নেন শ্রীপঞ্চ দশনামী মহানির্বাণী আখাড়ার বারাণসী শাখায় শ্রী অষ্টকৌশল সদস্য শ্রী মহন্ত রবীন্দ্র গিরিজিকে একটি মোক্ষম প্রশ্ন করেছিলেন, সধু মহাত্মাদের একটা আখড়া হওয়া উচিত, সাতটা আখড়া কেন? বেশ সন্তর্পণে উত্তর দেন গিরিজি। বলেন. প্রজন্মের পর প্রজন্মে মহাত্মারা যুক্ত হয়েছেন। সংখ্যা বেড়েছে আখড়ার। কিন্তু একই উদ্দেশ্য। ধর্মকে রক্ষা করা। এই সবআখড়ার পরিচালন ব্যবস্থা কি একই? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিটি আখড়ায় একেকজন শ্রীমহন্ত পদ আছে! যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়। আটজন শ্রীমহন্তকে নিয়ে অষ্ট কৌশল ,( পরিষদ) তৈরি হয়। তিনি এও বলেন শৈব হলেও তাঁরা বিষ্ণুরও পুজ করেন। ওঁ নমঃ শিবায় বিষ্ণু রূপায় শিব রূপায বিষ্নবে । শিবস্য হাদয়া বির্ষ্ণু বিষ্নোশ্চ হৃদয়ং শিবঃ ।।স্বয়ং কপিল মুনি শ্যাম বিষ্নু স্বরূপ আমাদের মাতাপিতা গুরু সবকিছু।এটাই পরম্পরা ৷ নাগা সন্ন্যাসীদের সংস্কার কি করে হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে গিরিজি বলেন, সব কথা খুলে বলা যাবে না। বিধি মিনে সাত পুরুষেরসঙ্গে নিজেরও পিন্ডি দান করতে হয়। এরপর তিনদিন মহা তপস্যা। এরপর হয় বির্যায়ন। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের জন্মদানে অক্ষম করা হয়। সংযম যেন নষ্ট না হয়। মোহে সন্ন্যাস ছেড়ে যেন বিয়ে না করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে কিছু গুপ্ত বিধি। তিনি সাক্ষাৎকারী সম্পাদক প্রভাত ঘোষকে বলেন নাগা দিগম্বর কো লিঙ্গ পূজন করাতা হ্যায় বিশেষ সাধনা কি বল পর ব্রহ্মচারী ক পালন কিয়া যাতা। উসকি ক্রিয়া কি যাতা, সাধনা practice করাতি, ইস সারি চিজে গুপ্ত রহতি হ্যায়। ই সব সাধনা উপর নেহি বতায়ি যাতি। সাধনা পর ধীরে ধীরে লিঙ্গমে কোই কাম তেজ নেহি রহতা। মন কা কন্ট্রোল হো যাতা হ্যায়।,, লিঙ্গ কে বাঁধকর লরি খিঁচ লেতা, লাঠি লাগাকে উসকে উপর এক দো মহাত্মা খড়ে হো যাতে,,, এ্যায়সাই বাড় যাতা। নাগা সন্ন্যাসীরা দাবি করেন শ্রী রামকৃষ্ণ তাঁদের ঘরানার সন্ন্যাসী। আচার্য তোতাপুরীর কাছেই রামকৃষ্ণ দীক্ষা নেন।( পৃষ্ঠা ১২৩/১২৬)
শিব সম্পর্কে শিব ও বুদ্ধ শিরোনামে এক নিবন্ধ লিখেছেন ড: আর এম দেবনাথ তাঁর সিন্ধু থেকে হিন্দু গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন মহাভারতের শুরুতেই দেখা যায় শিব তনয় গনেশ নিজ হাতে মহাভারত লিখেছেন। অথচ আমরা জানি ব্যাসদেব মহাভারতের রচয়িতা। তা হলে প্রকৃত ঘটনাটি কি? প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে ব্যাসদেব নিজের হাতে মহাভারত লেখেননি। ব্যাসদেব মৌখিকভাবে তা বলেছেন। লেখার দায়িত্ব ছিল শিব তনয় গণেশের ওপর। গোড়াতেই শিবের সাথে মহাভারতের এই সম্পর্ক কী প্রমাণ করে? এই ঘটনাটি যে মহাভারতকে ভূমিপুত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার একটি প্রয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা না হলে শিব পুত্র গণেশকে দিয়ে মহাভারত লেখানোর আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। অবশ্য এর আর একটি ব্যাখ্যাহতে পারে। হতে পারে ব্যাসদেব লিখতে জানতেন না ৷ ব্যাসদেব যেহেতু আর্যদের প্রতিনিধি তাই বলা যায আর্যদের কোনো লিপি ছিল না ৷ ( পৃষ্ঠা ৭৫) ড: দেবনাথ আরও লিখেছেন,মহাভারতের পর খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় চতুর্থ শতকের দিকেও দেখা যায় মহাদেবই প্রধানতম দেবতা। এই সময়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র চানক্য। চানক্য ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ( খ্রীষ্ট পূর্ব ৩২১-২৯৭) মন্ত্রী। এই চানক্যের নামে চালু চানক্য সংগ্রহ এ ( চৈতালি দত্ত সম্পাদিত ও ভাষান্তরিত : নব পত্র প্রকাশন : কলকাতা ২০০০)
দেখা যায় চানক্য বলছেন অসার এ সংসারে চারটি মাত্র সারবস্তু আছে। এগুলো হচ্ছে কাশীবাস , সাধুজনের সঙ্গলাভ, গঙ্গা জল ও শিব পূজা। যে চারটি সারবস্তুর কথা চানক্য উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটস্বয়ং শিব। গঙ্গা শিবেরস্ত্রী। কাশী ( বিশ্বনাথ মন্দির) শিবের লীলাভূমি । আর ধ্যানী শিব সাধু না হয়ে পারেন না। বলা বাহুল্য বহু উত্থান পতনের পরে আজকের দিনেও শিব ও তাঁর পরিবারভুক্ত দেব দেবীই হিন্দুর প্রধান উপাস্য। আলোচনার এই পর্যায়ে মহাদেব ও বুদ্ধের তুলনামূলক একটি বিচার করা দরকার? কারণ দেখা যায় শিবও বুদ্ধের মধ্যে প্রচুর মিল। এঁরা কখনও সমস্তরালভাবে পূজিত হচ্ছেন, আবার কখনও একজন আর একজনের হন্য জায়গা ছেডে দিব্দেন ৷ সমান্তরাল পূজার কথা উল্লেখ করেছেন দীনেশ চন্দ্র সেন ৷ তিনি বলেছেন: বুদ্ধ ও শিবের মূর্তি ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে জনগণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য ছিল। এদিকে জায়গা বদলের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় শিব অথবা বুদ্ধের জায়না কখনও আর্যদেবতা ব্রহ্মা অথবা বিষ্ু দখল করতে পারেননি৷ আমরা জানি শিব অথবা দ্রাবিড সভ্যতায় সাথেই আযদের তুমুল সংঘাত ঘটে। এই সংঘাত সংঘর্ষের পরিণামই গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধ ধর্ম। এই ধর্মটির প্রতিপত্তিকালে শিবের স্থান অনেকাংশে বুদ্ধ অধিকার করে নেন। কারণটি বোধগম্য। শিব অশরীরী দেবতা। আর গৌতম বুদ্ধ রক্ত মাংসের মানুষ হয়েও দেবতুল্য মহাপুরুষ। দুয়ের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে মিলই বেশি। মহাদেব সাধারণ মানুষের দেবতা ও তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তিনি যজ্ঞ ও বেদের বিপক্ষ শক্তি। ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে বৌদ্ধ কালে ভগবান গৌতম বুদ্ধ শিবের স্থলাভিষিক্ত হন। শিব আড়ালে চলে যান।(পৃষ্ঠা ৭৭/৭৯)