
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বাংলা ক্যালেন্ডার আজ ঐতিহাসিক বস্তু। ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে।নববর্ষের সকাল থেকে প্রস্তুতি। স্নান সেরে নতুন গেঞ্জি। বিকেলে নতুন জামা পড়ে অভিভাবকদের হাত ধরে দোকানে দোকানে হাল খাতার নেমন্তন্ন রক্ষা। পাইনাপ্যাল নামক সবুজ রঙের অখ্যাত কোম্পানির ঠান্ডা পানীয়। তেলে ভেজা গন্ডাখানেক জলখাবারের মিষ্টির বাক্স আর রিকেট রোগীর মত কিছু ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফেরা বীরদর্পে। ছোট দোকানের দেওয়া বাক্সে থাকত ঠান্ডা কঠিন কঠোর লুচি, কাই মাখা আলুর দম সিঙ্গারা, ডিমের সাইজের ভেজিটেবল চপ কিংবা নিমকি, দরবেশ লাড্ডু। একটু বনেদি দোকানের বাক্সে বাড়তি সংযোজন ছানার মিষ্টি। ব্যবসায়ীর ধার ও ভারের অনুপাতে ক্যালেন্ডারের গোছা। শিশুমহলে তখন ভোট গণনার মত গোনা হত কার ঝুলিতে কত ক্যালেন্ডার।অধিকাংশ ক্যালেন্ডারে গৌণ হত তারিখ মাসের হিসেব। মুখ্য বিষয় দেবদেবী আর দোকানদারের নববর্ষের শুভেচ্ছা সহ নাম ঠিকানা। সেসব দিনে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হতো কাঠের ব্লকে। ক্যালেন্ডারগুলি কিন্তু বাংলার ছাপাখানায় ছাপা হতো না। সেসব আসত শিবকাশী থেকে।

দিন বদলের সঙ্গে এখন ক্যালেন্ডার বহু রঙে ছাপা হয় আধুনিক অফসেট মেশিনে।এখন ডিজিটাল যুগে মানুষের রুচি পাল্টেছে।ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে ঘরের দেয়াল নষ্ট করে না বাঙালি। তাই ক্যালেন্ডার বিক্রিও কমে গেছে। বাংলা নববর্ষে ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বিপুল চাহিদা পঞ্জিকার। বিভিন্ন কোম্পানির পঞ্জিকা।মালিকদের ছবি সহ সেই সব পঞ্জিকার মলাট হতো গোলাপি। আজকাল একটু আধুনিক হয়েছে। তবে আজও বাঙালি গোলাপি কাগজে ছাপা বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়ের মত গোলাপি প্রচ্ছদের পঞ্জিকায় অভ্যস্ত। নববর্ষের সঙ্গে হালখাতার সম্পর্কই বা কি? সেযুগে কৃষক হাল চাষ করে ধান চাল ফসল কেন বেচা করত। তার হিসেব রাখা হত খাতায়। সেটাই হাল খাতা। পরবর্তীকালে সেই হালখাতা সব ব্যাবসায় প্রযোজ্য হয়। আজ আর হালখাতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কম্পিউটারের যুগ। সেখানেও আজ কম্পিউটার পুজো হয় তেল সিঁদুর মাখিয়ে।

বিজ্ঞাপন

ইদানিং কয়েকবছর ধরে রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে বাংলা নববর্ষে। সম্রাট আকবর না বাঙালি হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলার বর্ষ প্রচলন করেন তাই নিয়ে কাজিয়া । অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা অমর্ত্য সেন আর জয়সওয়ালের তথ্যে বিশ্বাস রেখে বলেন, বাংলাবর্ষের গণনার সূচনা সম্রাট আকবরের সৌজন্যে। হিন্দুত্ববাদীরা বলেন, অনেক আগেই বাংলার বাঙালি হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলা বর্ষের হোতা। এই নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।

বিশ্বভারতী বনাম অমর্ত্য সেন জমি নিয়ে কাজিয়ায় আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা অমর্ত্য সেনের বক্তব্য বাংলা সনের প্রণেতা আকবর এই ধারণার প্রবল বিরোধিতা শুরু করেন বিজেপি ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ।তাঁরা অমর্ত্য সেনের ২০০৫ সালে প্রকাশিত দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান গ্রন্থের বক্তব্যকে খারিজ করতে বলেন, আকবরের সভাসদ আবুল ফজল দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। একটি আকবরনামা, অন্যটি আইনি আকবরী। এই বই দুটিতে কোথাও বাংলা সনের উল্লেখ নেই।আবার ১ লা বৈশাখ নববর্ষ যে আকবরের অবদান সেই সমর্থকেরা বলেন, রাজা শশাঙ্কের সময় বাংলা ভাষার চল রাজকার্যে ছিল না। কয়েকবছর ধরেআর এস এস ঘনিষ্ঠ সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদের প্রবীর ভট্টাচার্য কলকাতায় শশাঙ্ক রাজার নববর্ষের প্রবর্তক প্রমাণ করার জন্য শোভাযাত্রা করছেন।অন্যদিকে ভাষা চেতনা সমিতি মূলত যাঁরা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত তাঁরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন,অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানকে হিন্দুত্ব আরোপের এক অপচেষ্টা।হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবী মোহিত রায় বলেছেন, মেকি অসাম্প্রদায়িক ধ্বজাধারীরা সাপ , প্যাঁচা প্রতীক নিয়ে মিছিল করেন।বাংলার সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? মোহিত সেনরা পণ্ডিত মানুষ। ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁরা বাংলার লোক উৎসবের প্রতীক সাপ বা প্যাঁচাকে ব্রাত্য করতে চান হিন্দুয়ানী প্রচার করতে। হুতোম প্যাঁচা নামে এক বাঙালির কথা বোধহয় এঁদের মনে নেই। তাঁর লেখা চড়ক পার্বণ লেখায় চোখ বোলালে বিষয়টা স্পষ্ট হতে পারে। বাংলায় মনসা মঙ্গল কাব্যে সাপের সঙ্গে বাংলার সম্পর্কও একবার ঝালিয়ে নেওয়া উচিৎ।

থেকে যায় পঞ্জিকা প্রসঙ্গ। কিন্তু পঞ্জিকার হিসেবে যে নববর্ষের দিন ক্ষণ তিথি ঘোষিত সেটা কি নির্ভুল? বিজ্ঞানের তথ্য কিন্তু বলছে,১ লা বৈশাখ আজ আর নববর্ষ নয়। একটু খতিয়ে দেখা যাক।১লা বৈশাখ সাধারণত হয় ইংরেজি মাসের ১৪ এপ্রিল বা ১৫ এপ্রিল। ফতেউল্লাহ শিরাজি আকবরের নির্দেশ মত বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছেন তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি তাহলে দেখব তিনি সূর্যের মহাবিষুব রেখার স্থিতি থেকে। যখন বঙ্গাব্দ চালু হয় তখন ১৪ এপ্রিল ছিল সূর্যের মহাবিষুব স্থিতি। আজকের হিসেবে সেই তিথি ২১ মার্চ। ফলে গণনায় পার্থক্য ২৩ দিনের। অয়ন বিন্দুর একদিন সরণ হতে সময় লাগে ৭২ বছর, তাই ২৩ দিনের পার্থক্য হতে সময় লেগেছে ২৩×৭২। মোটামুটি যা ১৬০০ বছর। অর্থাৎ এই হিসেব ৪০০ খ্রিস্টাব্দের। সুতরাং বৈশাখ নয়, বাংলার নববর্ষ গণনার সূত্র অনুযায়ী ২১ মার্চ। বাংলা পঞ্জিকা তৈরি হয় সৌর গণনার ভিত্তিতে। সূর্য সিদ্ধান্ত মতে ১ বছর ৩৬৫,২৫৮৭ দিন। কিন্তু ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে একদিন০.০১৬৫৫৬ দিন। ফলে ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের পার্থক্য থেকে গেছে। হিসেবেও তাই গন্ডগোল। প্রাচীন সংস্কারেই আস্থা পঞ্জিকা নির্মাণকারীসংস্থাগুলি। সেখানেও রয়েছে ভিন্নমত। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত ও দৃকসিদ্ধ সিদ্ধান্তে রয়েছে গরমিল। তবু সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের জেরে পঞ্জিকা আজও লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়। আমরা সেই ত্রুটিপূর্ণ সময়ের তিথি মেনে নববর্ষ পালন না করে তারিখ ধরে নববর্ষ পালন করছি। অর্থাৎ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। বিজ্ঞানের তর্ক বিবেচ্য নয়। আমরা বরং এই নববর্ষের হোতা আকবর না শশাঙ্ক তাই নিয়ে কয়েকটা দিন মেতে থাকি। তারপর বিতর্ক টা তুলে রাখবো চিলেকোঠায়। আসছে বছর আবার হবে।

বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা দেশের বিভিন্ন প্রদেশের নববর্ষের ত্রুটিপূর্ণ গণনার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুজির কাছে।প্রধানমন্ত্রী সম্মত হলে বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা ১৯৫৭ সালে ২২ মার্চ ও ১৮৭৯ শকাব্দের পয়লা চৈত্রকে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু নাগরিক স্বীকৃতি না মেলায় ১ লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে চলেছে। শশাঙ্ক না আকবর তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, বাংলার নবান্ন পৌষ সংক্রান্তির পর ১ লা অঘ্রানে। অগ্রহায়ণ। অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস। সেটাই বাঙালির নববর্ষ।১ লা বৈশাখ রাজার কর আদায়ের দিন। বাকি থাকা খাজনা আদায়ের দিন। তাইতো ব্যবসায়ীরা দিনটি বেছে নিয়েছেন সারা বছর ধারে যেসব পণ্য বিক্রি করেছেন সেই বাকি টাকা আদায়ের দিন। বদলে গ্রাহককে একটু মিষ্টিমুখ করানো। জমিদাররাও সেকালে তাই করতেন। কিন্তু বাজারি সংস্কৃতি দিনটির একটা নকল তাৎপর্য তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা তাই বাজারি সংস্কৃতিকে বাংলা সংস্কৃতি ভেবে মহানন্দে নববর্ষ হিসেবে পালন করছি। মারাঠিরা চৈত্রের শুক্লা প্রতিপদে পালন করেন নববর্ষ। বলা হয় গুড় পড়ওয়া।তেলেগুরা উগাড়ি বা যুগাদি, মারোয়ারিরা ঠাপ্না, সিন্ধিরা চৈতি চাঁদ। কাশ্মীরের মানুষ নওরোজ। তামিলনাড়ুতে নববর্ষ পুথান্ডু। পাঞ্জাবে বৈশাখে ফসল ওঠে এবং গুরু গোবিন্দ সিংয়েরবার্ষিকী। অসমে বিহু, ওড়িশায় পানা সংক্রান্তি। মোদ্দা কথা বৈশাখি নববর্ষ রাজকোষে খাজনা পরিশোধ করার সামন্ততান্ত্রিক নিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিজ্ঞাপন
