বেশ্যার বারোমাস্যা

পর্ব: ২৭

মিশরের ফারাও


সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আবার দেবদাসী প্রথা প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি মিশরে। দেবদাসী গ্রন্থে আরতি গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, রামেশিষ বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার যুগ্মভাবে তানিস এর ফারাও ও হীবসের প্রধান পুরোহিতের হাতে ন্যস্ত হয়। পারস্পরিক বিবাহ এবং দত্তক গ্রহণ প্রথা এই দুই বংশে চলতে থাকে এবং দানিস এর রাজাকে কন্যারা হীবসের মন্দিরে আমন দেবের পত্নী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন।যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারিণী হন। এই ইতিহাসকে দেবদাসী প্রথার প্রাচীন ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় দেবদাসী।

সমাজের ওপরতলার মহিলারা এবং ক্রীতদাসীরা, উভয়েই মন্দিরের দেবদাসী পর্যায়পরিগণিত। তবে এই দাসত্বের শ্রেণীভেদলক্ষ্য করার মত। এরপর আসিরিয় সভ্যতা ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাসেও একই ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এযুগের সমস্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটি ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেবতারা ছিলেন মারডুক, শামাস তাম্বুজ ও ইশতার। দেবী ইশতারের সঙ্গিনী হিসেবে মন্দিরে দেবদাসীদের নিযুক্ত করা হত। প্রাচীন ব্যাবিলনের নিয়মও ছিল রাজ্যের প্রতিটি বিবাহযোগ্যা মেয়েরা দেবীর মন্দিরে আসবেন নির্দিষ্ট দিনে। অপেক্ষা করবেন পুরোহিতের নির্দেশ মত এক পুরুষের শয্য্যাসঙ্গিনী হতে হত। তবেই বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে স্বীকৃত হত।

পদ্মপুরাণ শাস্ত্রে দেবদাসী হিসেবে কন্যাদানের বিধান আছে।

আমাদের দেশে দেবদাসী প্রথার উৎপত্তি সম্পর্কে একটু নজর দেওয়া যাক। পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে, রূপবতী যুবতী নারী অলঙ্কার ও শয্যাসহ দান করিয়া নর অনন্ত ফল প্রাপ্ত হয়।; যুবতী ও কন্যা এই উভয় দানেরই তুল্য ফল; পরন্তু একজন বরকে এবং অপরজন ব্রাহ্মণকে প্রদান করিতে হয়। ধীর ব্যক্তিক্রীত কন্যাকে দেবোদ্দেশে দান করিবেন। এইরূপ দানে কল্পকাল দাতার স্বর্গভোগ হয়। অথবা তিনি ভূতলে মহাধনসম্পন্ন রাজা হইয়া থাকেন । জন্মে জন্মে তাহার বর বর্ণিনী সুপত্নী লাভ হয়।( দ্বিপঞ্চাশ অধ্যায় (৫২)।

ইতিহাসে গুজরাটের সোমেশ্বর মন্দিরে ৫০০ দেবদাসীর অস্তিত্বের উল্লেখ আছে

১১ শতকের শিলালিপিতে দক্ষিণ ভারতে থাঞ্জাভুর মন্দিরে ছিল ৪০০ দেবদাসী। গুজরাটের সোমেশ্বর মন্দিরে ছিল ৫০০ দেবদাসী। দেবদাসী প্রথা আমাদের দেশে বহুল প্রচলন শুরু ষষ্ঠ শতাব্দীতেই। বিভিন্ন প্রাচীন কলহণের রাজতরঙ্গিনী, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, দামোদরের কুট্টনীতম ইত্যাদি গ্রন্থে দেবদাসী প্রথার্ উল্লেখ আছে। বাংলায় বৈদিক সভ্যতার প্রভাব পড়ার পর থেকে দেবদাসী প্রথার প্রচলন হয় সেন বংশের বিজয় সেনের আমলে। দেবদাসীদের উত্তর ভারতে বলা হত মুখী। দক্ষিণ ভারতে বলা হয় মুটটুকটটুভাদু ও দেভারিগে বিদুভাগু। উচ্চবর্ণের ধনী নাগরিকদেরও নিজেদের কন্যাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেবদাসী হিসেবে মন্দিরে পাঠানো হত। আসলে ব্রাহ্মণ যতক্ষণ না ভোগ করছে ততক্ষণ সমাজে স্বীকৃতি মিলত না। পারস্যের ইতিহাসও বলছে সেদেশেও রাজা আমিরাহদেরও নিজেদের কন্যাকে মন্দিরে পাঠাতে হত? আমাদের দেশে সাধারণত গরীব মানুষ কন্যাদান করত টাকার বিনিময়ে। অবশ্য ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের চাপেও মেয়েকে উৎসর্গ করা হত দেবতার কাছে। প্রথম রাতে কুমারী কন্যা চেখে দেখার দায়িত্ব বর্তাত ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের। কোনো উচ্চবিত্তের পরিবারে সন্তান না হলে ধরে নেওয়া হত স্ত্রী বন্ধ্যা। তখন দেবদাসী ব্যবহার করা হত। যদি প্রমাণ হত পুরুষ অক্ষম সেক্ষেত্রে পুরোহিত ধনীর স্ত্রীকে নিয়ে রাত কাটাতেন। এই প্রথাকে বলে গুরুপ্রসাদী।( চলবে)

পরবর্তী পর্ব ২৭, আগামী শুক্রবার ১৯ জুলাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *