বেশ্যার বারোমাস্যা। পর্ব :৫

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান সময়ের বেশ্যার বারোমাস্যা প্রতিবেদনে এখনও বাংলার কথা বলিনি। এই পর্বে বাংলার যৌন সমাজ সম্পর্কে একটু তথ্য দিচ্ছি। পরবর্তী পর্বগুলিতে বিস্তারিত জানাব। বাংলার গণিকা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে বাংলার দাস ব্যাবসা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। পর্তুগিজ ব্যবসায়ী বারবোসাও বাংলায় দাসপ্রথার কথা উল্লেখ করে গেছেন। পরবর্তী সময়ে আবুল ফজল আইন ই আকবরী তে এবং জাহাঙ্গীর আত্মজীবনীতে বাঙালি দাসদাসীর কথা লিখে গেছেন।চন্দননগরের ফরাসি মহাফেজ খানার দলিলে আছে হুগলি জেলার চার ধরনের দাসদাসীর কথা।বাংলার দাস ব্যবসার তথ্য মেলে শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে। যেখানে বলা হয়েছে নাহা লুহা বেচিবে ব্রাহ্মণে কন্যা বেচি বেক যে সব শাস্ত্র জানে। সেযুগে বাংলায় রাজস্ব না দিতে পারলে সন্তান বিক্রির চল ছিল।বাংলার ঐতিহাসিকেরা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। দাস ও দাসীরা শুধু যে ফাই -ফরমাস খাটত সেটা ভাবা ভুল হবে। প্রভুর যৌন তৃপ্তি দেওয়ারও ও দায় থাকত এই দাসদাসীদের। অনেক সময় মালিকের স্ত্রীর যৌনইচ্ছাও পূরণ করতে হত দাসেদের। অন্তঃপুরে থাকা স্ত্রীদের তো বাইরে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেকে স্বামীর অবর্তমানে দাসীদের সঙ্গে সমকামী হতেন।।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলায় যদি মধ্যযুগে দাস ব্যবসার চল থেকে থাকে,তাহলে কি যৌন কর্মী ছিল না? অবশ্যই ছিল। বেদে, রামায়ণে, মহাভারতেও গণিকা বৃত্তির কথা আছে। পাল বংশের আমলে যদিও কিছুটা আড়াল ছিল,কিন্তু সেন বংশের আমলে গণিকাবৃত্তির প্রসার ঘটে।সেনবংশের আগমন ঘটেছিল কর্ণাটক থেকে।আমরা জানি সেখানে দেবদাসী প্রথা ছিল সমাজ স্বীকৃত। গৌড় বাংলায় সেন বংশের আমলে যৌনতা ছড়িয়ে পড়ে সমাজে। গৌড় বাংলার গৃহবধূদের একাংশ ব্রাহ্মণ, মিত্র, ভৃত্য ও দাসের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত চাহিদা পূরণের জন্য।হিন্দু রাজপরিবারে পুষ্পদান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিধান মানতে রাজপত্নীরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় রাজ পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যৌনমিলনে বাধ্য হন।

বিজ্ঞাপন

এই সম্পর্কে ভারতীয় সমাজে প্রান্ত বাসিনী,,, গ্রন্থে (সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার, কলকাতা) লেখক সুরেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ও রমলাদেবী লিখেছেন, বঙ্গদেশে গণিকা বৃত্তির ব্যাপকতার অন্যতম কারণ বোধহয় এই দেশের লোকের প্রাচুর্য্য বারাঙ্গনা বৃত্তির উদ্ভব তীর্থস্থানে ও শহরে হয়েছিল বলে মনে হয়। কালক্রমে গ্রামাঞ্চলেও গণিকা বৃত্তি শুরু হয়। এই সম্পর্কে ড: সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর । ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ গ্রন্থে একটি মূল্যবান মন্তব্য করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, যে সমাজে সতী শব্দের অনুরূপ অর্থে পুংলিঙ্গ শব্দ ছিল না, যেখানে চরিত্র বলতে শুধু যৌন শুচিতাই বোঝায়। যেখানে পুরুষের যৌন মাধুকরীবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে এসেছে চিরকাল। সেখানে নারীর সামান্যতম পদস্খলন বরাবরই চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত হয়ে এসেছে।

এবার একটু সময় টপকে আসব ১৯ শতকে। ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হরিদাসের গুপ্তকথা গ্রন্থে লিখেছেন, গরাণহাটা থেকে কলুটোলা রাস্তাপর্যন্ত বেড়িয়ে দেখলেম, দুধারি বারান্দায় রকমারি মেয়েমানুষ, অনেকরকম মেয়েমানুষ। গৃহস্থের বাড়ির কাছে বেশ্যা , ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালো মানুষের মাথার ওপর বেশ্যা। অধিক কথা কি, ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আষ্টেপৃষ্ঠে বেশ্যা। বেশিদিনের ঘটনা নয়,, উত্তর কলকাতা বা মধ্য কোলকাতার সোনাগাছি বা হারকাটা লেনেই যে শুধু পতিতাপল্লী ছিল তা নয়। সিমল পাড়ায় বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি ও মামার বাড়ির মধ্যে একটি পাড়ায় কয়েকমেয়েরা থাকত।। আবার খান্না সিনেমার কাছে যেখানে সাহার হাট বসে সেখানেও টিনের ছাদওলাবস্তিতে দেখা মিলত দেহপোজীবিদের। বিকেল হলেই সস্তার পাউডার আর লিপস্টিক লাগিয়ে টেনে চুল বেঁধে সস্তার চকমকে কিম্বা জংলী ছা শাড়িতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে তাঁ দাঁড়াতেন।। দলে যেমন কচি কাঁচা ছিল, তেমন তরুণী, মধ্যবয়সী ও বিগতা যৌবনারাও থাকতেন।১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হরিদাসের গুপ্তকথা বইটি শুধু নয়, উনিশ শতকের প্রথমে প্রকাশিত দাশরথি রায়ের পাঁচালি,১৮৬১-৬৪ সালে প্রকাশিত হুতোম প্যাঁচার নকশা,১৮৬৯ নাগাদ প্রকাশিত প্রাণকৃষ্ণ দত্তর বদমায়েশ জব্দ এবং ১৮৭৯ তে দুর্গাচরণ রায়ের দেবগণের মর্তে আগমন প্রভৃতি গ্রন্থে কলকাতা শহর জুড়ে ক্রমবর্ধমান পতিতাপল্লীর ভৌগলিক বিন্যাসের চিত্র তুলে ধরে।

বিজ্ঞাপন

১১ মার্চ ১৮৫৭। সেদিন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় ছাপা হয়, কলিকাতা নগরে সকল পল্লীতেই বেশ্যাবাস হইয়াছে, গৃহস্থ বেশ্যায় মিশাইয়া গিয়াছে, বাটীর প্রভেদ বুঝা যায় না। বেশ্যাদিগের কদাচার ও দৌরাত্ম্যে গৃহস্থরা অত্যন্ত উত্যক্ত হইবার পর কলিকাতা নগরের সুযোগ্য সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী যুত মেংহিউম সাহেব বেশ্যা মর্দনে প্রকৃষ্ট যত্নবান হইয়াছেন, যে বারাঙ্গনারা ভদ্র গৃহস্থের বাটীর নিকট সর্বদা কদাচার ও গোলযোগ করে তিনি তাহাদিগের অর্থ দণ্ড করিতেছেন। জরিমানা দিয়াও যে কুলটারা পুনর্বার অত্যাচারাম্ভ করে সুবিচারক শান্তিরক্ষক মহাশয় তাহারদিগকে সেই পল্লী হইতে উঠাইয়া দিতেছেন, তালতলা, জানবাজার প্রভৃতি স্থানবাসিনী কতিপয় বারবিলাসিনী এইরূপে পল্লীবহিষ্কৃতা হইয়াছে, আমরা প্রার্থনা করি শ্রীযুত মেংহিউম সাহেব নগরের উত্তরাংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহস্থদিগকে বারঙ্গনাগণের উৎপাত হইতে রক্ষা করুন।( চলবে)

পর্ব: ৬

আগামী সোমবার ২২ এপ্রিল, রাত ১১ টায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *