গণেশ চতুর্থীতে মাতছে দেশ, কিন্তু গণেশ কি শুভ দেবতা?

পর্ব : ৩

বেদব্যাস ডিক্টেশন দিয়েছেন, মহাভারত নয়, জয় মহাকাব্য লিখেছেন গণেশ।

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : গণেশ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় পর্বেই জানিয়েছিলাম বৈদিক যুগে আজকের যেসব দেবতা পূজিত হন কেউ ছিলেন না। একথা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনাবলীতেই লিখে গেছেন। বলা হয় বেদব্যাস মুখে রচনা করেছেন মহাভারতের শ্লোক। একনাগাড়ে লিখেছেন গণেশ। যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নেওয়া যায় বেদব্যাস এক পণ্ডিত মহাভারতের রচনাকার তিনি কি নিজে লিখতে জানতেন না।? তাছাড়া শাস্ত্র বলছে বেদব্যাস লিখেছেন জয় মহাকাব্য। মহাভারত নামকরণ তো অনেক পরে। রাজশেখর বসু তাঁর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত : সারানুবাদ গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন, মহাভারতকে পঞ্চম বেদ বলা হয়। যে সকল খণ্ড খণ্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য পুরাকালে প্রচলিত ছিল তাই সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে।

রাজশেখর বসু মহাভারতের বঙ্গানুবাদ লিখতে গিয়ে বলেছেন গ্রন্থটি বহু লেখকের লেখার মিশ্রণ।

রাজশেখর বসু এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে এও বলেছেন, মহাভারতে যে ঘটনাগত অসঙ্গতি দেখা যায় তার কারণ বিভিন্ন কিংবদন্তীর যোজনা। চরিত্রগত অসঙ্গতির কারণ বহু রচয়িতার হস্তক্ষেপ, অন্য কারণ প্রাচীন ও আধুনিক আদর্শের পার্থক্য। অর্থাৎ গণেশের মহাভারত রচনা গালগপ্পো ছাড়া কিছু নয়। তার একটা বড় প্রমাণ , পুরাকাহিনীতে আছে গণেশকে বেদব্যাস না থেমে লিখে যেতে বলেন। তাই গণেশ নিজের একটা দাঁত ভেঙে লিখতে শুরু করেন। আবার আর এক পুরাভাষ্যে আছে পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধে ( শিবের এক কুঠার ছিল ) গণেশের একটি দাঁত ভেঙে দেন। প্রশ্ন ছেলের মুন্ড খসে গেলে পিতা শিব গোটা মুন্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে জুড়তে পারেন একটা দাঁত স্থাপন করতে পারেন না? সেসব কথা থাক। গণেশ সম্পর্কে ফিরে যাই।

যাঁরা গুগল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ছাত্র তাঁরা জানেন গণেশ শব্দের উৎপত্তি গণ + ঈশ থেকে। অর্থাৎ সাধারণের ঈশ্বর বা প্রভু বা আরাধ্য। সেখানেই নাম মেলে বিঘ্নেশ্বর। গণ শব্দের প্রকৃত অর্থ এক বিশেষ গোষ্ঠী।সে কথায় পরে আসব। এখন গণেশ সম্পর্কে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিশ্রী দুর্গা গ্রন্থে কি লিখেছেন দেখা যাক। তিনি লিখেছেন,,,,,,,, গণপতি গণেশ আসলে মিত্র দেবতার একটি ভিন্ন রূপ। গণপতি গণানাং পতি:। অর্থাৎ শিবসঙ্গী প্রমথগণের অধিনায়ক গণেশ সন্ধ্যারই অধিদেবতা। সন্ধ্যার অন্ধকার প্রমথগণের আশ্রয় , বিনায়ক সেই গণের পতি আর সেজন্য তিনি গজেন্দ্রবদন – কৌলিন্য ও ব্রাত্যের মিশ্রণ অথবা প্রতীক। গণপতি সন্ধ্যার প্রতীক বলে সন্ধ্যারূপিনী লক্ষ্মীদেবীর পাশে তাঁর স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ( পৃষ্ঠা ১০৭)

স্বামীজীর গণেশ তথ্য একটু থামিয়ে প্রমথ শব্দের অর্থ জেনে নেওয়া যাক। প্রমথ শব্দের অর্থ শিব অনুচর। বেদে শিবের প্রথমে কোনো স্থান ছিল না। পরে অনার্যদের শাসন করতে তাঁদের দেবতাকে ঢোঁক গিলে মানলেও বেদের রুদ্রেরস্থান দিয়ে বলা হয় ধ্বংসের দেবতা। শিব অনুচরেরা সতীর দেহত্যাগের পর বীরবাহুর নেতৃত্বে দক্ষরাজের যজ্ঞস্থল নষ্ট করে। বিঘ্ন ঘটায়। গণেশও এক প্রমথ। অর্থাৎ বিঘ্নকারক। গণেশ পুজো হতো যেন অমঙ্গলের কোপ না পড়ে। ঠিক যেভাবে শনির পুজো মানুষ ভক্তিতে নয়, ভয়ে করে। গৃহস্থের ঘরে তাঁর ঠাঁই নেই। রাস্তায় রাস্তায় তাই শনিদেবের এত দাপট। প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু গণেশ যদি অমঙ্গলের দেবতা হন , তবে গৃহে স্থান পান কি করে? আসব আসব। সেই প্রসঙ্গেও আসব।

শিব অনুচর নাগ উপজাতিদের আরাধ্য

প্রথমে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ গণেশ সম্পর্কে কি বলেছেন সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নিই। স্বামীজী লিখেছেন, গ্রিস ও রোমেও গণপতি সিদ্ধিদাতা জুনো নামে পুজো পান। হিন্দু তন্ত্র ছাড়া বৌদ্ধ সাধনমালায় গণপতিকে ওঁং রাগ সিদ্ধি সিদ্ধি সর্বার্থং মে প্রসারয় প্রসাদয় হুঁ জ জ স্বাহা বলে আহবান করা হয়েছে।,,,,,,,,,,, স্বর্গীয় প্রাচ্চ্যার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, ভবিষ্যপুরাণে বিনায়ক যে সূর্য মন্দিরে পূজা পেতেন তার নজির পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে সৌর মগরা বিনায়কের যে মূর্তি গড়ে পূজা করত আর হিন্দু ও মহাযান বৌদ্ধরা তাদের কাছ থেকে ঐ পূজার রীতি নিছক ধার করেছিল এরকম অনুমান করাও কিছু অসঙ্গত নয়। (চলবে)

পরবর্তী পর্ব আগামীকাল, ৮ সেপ্টেম্বর রবিবার ,২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *