*
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: শনিবারের বারবেলা। কলকাতা প্রেসক্লাবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয় বিষয় : ভারতের সংবিধান কি বিপন্ন? সেমিনারের প্রথম বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট বামপন্থী আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়।সব্যসাচী বাবু জানালেন, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে বিশ্বজনীন মান কমেছে ৭.৬ পয়েন্ট। বিশ্ব সূচকে ভারতের ২০২৩ এ স্থান ছিল ১৬১। ২০২৪ এ সেই মান দু ধাপ উন্নতি ঘটে হয়েছে ১৫৯। পাকিস্থান ও শ্রীলঙ্কার সূচক আমাদের দেশের চেয়ে ভালো। দেশের নাগরিক ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের অধিকার কতটা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার মাপকাঠির ওপর নির্ভর করছে ।সংবিধান কিন্তু সবাইকে মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বাক স্বাধীনতায় সুযোগ নিয়ে কেউ যদি অপব্যবহার করে সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ দরকার।কিন্তু সেই মাপকাঠি কি? ২০১২ সালের শেষ থেকে রাষ্ট্র এক সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। রাজ্যে ও কেন্দ্রে দুটি ক্ষেত্রেই ছবি এক। আমরা সংবিধান বিপন্ন নয় বলে আশ্বস্ত থেকে আসলে সংবিধানকে সংকটে ফেলেছি। রাষ্ট্রশক্তির সমালোচনা করলে , মিমিক্রি করলে পুলিশ ধরছে। আজ বহু ডিজিটাল মাধ্যমের সাংবাদিক রাষ্ট্রের রোষে পড়ে পুলিশ ও আদালতের নাগপাশে বন্দী হচ্ছে। আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রমাণ সহ সমালোচনা করতেই পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতাকে আটক করা হল। এমন ঘটনা ঘটবে আরও এটাও ঠিক। তবে এখনও সংবিধান বিপন্ন হয়নি বলেই আমরা আলোচনা করতে পারছি। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি সরকারি ক্ষমতা হাতের মুঠো রাখতে ছলে বলে সংবিধানকে দূর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।
অন্যতম বক্তা ছিলেন পূবের কলম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরান। ইমরান বলেন, দেশ এখন সংকটে। কেন্দ্রীয় সরকার জাতি ধর্ম ভেদাভেদের রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে। যা সংবিধানের বিরোধী। অনেক কষ্টে পাওয়া সেই সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে সাংবাদিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এদিনের অনুষ্ঠানে বেশ কিছু সাংবাদিক ও সমাজের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের স্মারক প্রদান করে সম্মানিত করা হয়।
অনুষ্ঠানের আর এক অন্যতম বক্তা প্রেস ক্লাব সভাপতি স্নেহাশিস সুর বলেন, দেশের সংবাদমাধ্যম কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে থাকলেও ডিজিটাল মিডিয়ার কোনো স্বীকৃতি বা বিধিবদ্ধতার বিষয় ছিল না। কিন্তু ২০২৩ এ বিশেষ আইনে ডিজিটাল মিডিয়াও এখন কঠোর নিয়মের আওতায় এসেছে। ফলে যাঁরা স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন অনেকক্ষেত্রেই তাঁরা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখছেন। তবু এখনও রাজ্যের উদ্যোগে স্বীকৃতির ব্যবস্থা হয়ে ওঠেনি। তবে যেসব কঠোর আইন কেন্দ্র এনেছে সেখান ডিজিটাল সাংবাদিকতায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় জেনে বা না জেনে কল্পিত সংবাদ পরিবেশন সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন। উপস্থিত ছিলেন প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি প্রসূন আচার্য। তিনি বলেন,কেন্দ্রীয় সরকার সাংবাদিকতার স্বাধীন সত্ত্বাকে কুক্ষিগত করছে।সেই বিষয়ে স্বাধীন সাংবাদিকদের যেমন ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, তেমন দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে হবে।
সংগঠনের সভাপতি শ্যামলেন্দু মিত্র বলেন, বিশ্বজুড়েই এখন সাংবাদিকদের চাকরি স্থায়ী নয়। দেশের দুটি বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থার হাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম। ফলে তাঁদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করার কাজে সাংবাদিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। রুটিরুজির তাগিদে বড় সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা শৃঙ্খলে আবদ্ধ। জনসাধারণের কাছেও বড় সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বরং সাহসের সঙ্গে সঠিক সংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম। বহুক্ষেত্রে ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি মানুষের সমর্থন বড় মিডিয়ার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে ডিজিটাল ও জেলার ছোট ছাপা কাগজের সাংবাদিকদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পত্রিকায় সাধারণ সম্পাদকের কলমে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাজাহান সিরাজ জানিয়েছেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সরকার অনুমোদিত একটি স্বাধীন কল্যাণমুখী সংস্থা। সংগঠন সুস্থ সাংবাদিকদের পাশে থাকে।জনকল্যাণমুখী কাজেও যে আমরা অগ্রণী সেকথা প্রমাণ করেছি করোনা প্রবাহে। সহ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রশাসনের কাছে বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য দাবি জানিয়েছি স্বাধীন সাংবাদিকতার স্বার্থে।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষানবীশ বহু ছাত্রছাত্রী। অনুষ্ঠানের মুখ্য আকর্ষণ দেশের সংবিধান কি সংকটে সম্পর্কে একটি তথ্যবহুল আলোচনা পাবো। কিন্তু নিরাশ হতে হল।
জানার আগ্রহ ছিল ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করল ১৫ আগস্ট। সেদিন স্বাধীনতা দিবস।স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিজস্ব সংবিধান ছাড়া স্বাধীনতা দিবস কি করে পালিত হয়?১৯৪৭ যদি স্বাধীনতা দিবস হ তাহলে ১৯৪৮ পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেনের মত ব্রিটিশ নাগরিক স্বাধীন দেশের গভর্নর জেনারেল হন কি করে? মনে রাখা দরকার ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথমে মাউন্টব্যাটেন পরে রাজা গোপালাচারী একটি ব্রিটিশ ব্লু রঙের পতাকা ব্যবহার করতেন যেখানে পতাকার মাঝ বরাবর ব্রিটিশ রাজের ক্রাউন ও নিচে সোনালি রঙের ইন্ডিয়া লেখা।
এ হোক্স তাঁর ফ্রিডম অফ ইন্ডিয়া বইতে তো স্পষ্ট লিখেছেন ১৯৪৮ সালে ২১ জুন রাজা গোপালাচারী গভর্নর জেনারেল হিসেবে মাউন্টব্যাটেনের উত্তরসূরী হিসেবে শপথ নিতে গিয়ে বলেছিলেন _ আমি চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী যথাবিধি প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ , তাঁর বংশধর এবং উত্তরাধিকারীদের প্রতি আইনানুসারে বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকব এবং আমি চক্রবর্তী রাজা গোপালা চারী শপথ নিচ্ছি যে আমি গভর্ণর জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত থেকে সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ , তাঁর বংশধর এবং উত্তরাধিকারীদের সুচারু ও যথাযথ ভাবে সেবা করব। এই প্রেক্ষিতে স্বাধীন দেশের সংবিধান লেখা কতটা ব্রিটিশ সাংবিধানিক সূত্রকে সমর্থন করে ? ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণ পরিষদ সেই স্বাধীন ভারতের সংবিধান অনুমোদন করে এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাথে সাথে সংবিধান আইনত স্বীকৃত হয়।বিষয়টিতে কি একটুকুও অসচ্ছতা নেই? একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের মত সংগঠন ছাড়া এই বিষয়ে আলোচনার পরিসর আর কোথায় মিলত?