*
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: সিংহাসন ! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ- তাহারে দিতেছ মাত:, রাজ্যের আশ্বাস।…….আজ যদি রাজ জননীরে মাতা বলি, কুরুপতি কাছে বদ্ধ আজি যে বন্ধনে, ছিন্ন করে ধাই যদি রাজ সিংহাসনে তবে ধিক মোরে। ……..⁷যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করো না করো না আহ্বান,,, শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে, জয়লোভে যশোলোভে, রাজ্যলোভে অয়ি, বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য কর্ণকুন্তী সংবাদের মূল প্রতিপাদ্য এটাই। যদিও মধু কবি বীরাঙ্গনা কাব্যনাট্যের সূচনা করেন, কিন্তু আধুনিকতর হয়ে ওঠার জন্য বাংলা সাহিত্যকে অপেক্ষা করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপিয়ান সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় দেশীয় ধারায় কাব্য নাট্য রচনায় পরীক্ষামূলক নির্মাণ করেন রুদ্রচণ্ড। পৃথ্বীরাজের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় সেই রচনার পর বিবর্তন ঘটান পরবর্তী কাব্যনাট্য প্রকৃতির পরিচয় শীর্ষক রচনায়।
দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায় ও অলকানন্দা রায়।
সময়টা ছিল ১৮৮৪। বিষয় ছিল গুহাবাসী এক সন্ন্যাসীর মৃত্যু সম্পর্কে এক অনুভূতি। রচনার প্রাথমিক ধাপে ছিল বেশ কিছু দুর্বলতা। এরপর রাজা ও রাণী, বিসর্জন সহ আরও কয়েকটি কাব্যনাট্য। কিন্তু রবীন্দ্র বিশ্লেষকরা বলেন ,রবীন্দ্রনাথের সেরার সেরা কাব্যনাট্য কর্ণকুন্তী সংবাদ। যাঁরা মহাভারতের এই উপাখ্যান জানেন, তাঁরা কর্ণকুন্তী উপাখ্যানটি নিয়ে বহুদাবিভক্ত। কেউ বলেন , মাতৃস্নেহ ছাপিয়ে যায় রাজমহিষী পরিচয়কে। অন্যদিকে কর্ণ একদিকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত থাকায় যেমন নিজেকে ভাগ্যহীন ভাবেন, অন্যদিকে গর্ভদায়িনীর প্রতি অভিমান, সব কিছু ছাপিয়ে কুরুবংশের স্বীকৃতির প্রতিদানে জীবনপণের প্রতিজ্ঞা এক বহুমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যা ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কাব্যনাট্যে। এই কাব্যনাট্যের সার্থক মঞ্চায়ন করলেন এযুগের প্রতিশ্রুতিবান নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায়। কুন্তী চরিত্রে দ্রাবিণের সঙ্গে জুটি বাঁধেন স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী ও সমাজকর্মী অলকানন্দা রায়।
গুরু কোহিনূর সেন বরাট ও দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায়।
রবীন্দ্র প্রয়াণের ২২ শে শ্রাবণ দিনটিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে মঙ্গলবার জ্ঞানমঞ্চে রবীন্দ্র স্মরণ করল দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত এথেনিক ড্যান্স একাডেমী। অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে দর্শকের আসনে সাম্প্রতিককালে প্রয়াত মায়ের প্রতিকৃতি রেখে দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু করলেন। প্রথম পর্বে ছিল গুরু কোহিনূর সেন বরাটের রবি কবির দেবতার গ্রাস অবলম্বনে একক কাব্যনাট্য, কবীর সেন বরাটের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। ছিল আরেক বিখ্যাত পলি গুহের উপস্থাপনা। রবীন্দ্র রচনা অবলম্বনে দ্রাবিণের একাডেমীর ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশন করেন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান।প্রধান আকর্ষণ ছিল অবশ্যই দ্রাবিণ ও অলকানন্দার কর্ণকুন্তী সংবাদ নৃত্য পরিবেশন। দ্রাবিণ শব্দের অর্থ সম্পদ। নিজের নামের যথার্থতার প্রমাণ রেখে দ্রাবিণ প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছেন নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি বাংলার সম্পদ।
নৃত্যশিল্পী পলি গুহ।
দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, সম্প্রতি আমি আমার মাকে হারিয়েছি। মা ও পুত্রের বিচ্ছেদ অনুভূতি আমাকে বিচলিত করেছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মহাভারতের প্রতিটি পর্ব আজও প্রাসঙ্গিক। তাই রবীন্দ্র প্রয়াণে তাঁর কর্ণকুন্তী সংবাদ মঞ্চস্থ করে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি আমার মায়ের বিচ্ছেদের অপূর্ণতা পূরণ করেছি অলকানন্দা রায়ের কাছে। তিনি আমাকে পুত্র স্নেহের আঁচলে ঢেকে রাখেন। তাই কুন্তী চরিত্রে তাঁর উপস্থিতি। মঞ্চে আমাদের এই উপস্থাপনা প্রথম। আমার শিক্ষাগুরু কোহিনূর সেন বরাট এবং আমার মাতৃসমা অলকানন্দা আমাকে কর্ণ চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে নতুন কিছু সূত্র দিয়েছেন।
অলকানন্দা বলেন, এই প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিবান পরিণত নৃত্যশিল্পী দ্রাবিণ এক গুণী ছেলে। আমার পুত্রসম। বরাবরই আমার মহাভারতের দুটি চরিত্র কুন্তী ও গান্ধারীর প্রতি দুর্বলতা আছে। ইচ্ছে ছিল একটি নৃত্য পরিকল্পনার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আজ কুন্ত চরিত্রে মঞ্চায়ন করার সুযোগ এসে গেল দ্রাবিণের পরিকল্পনায়। যেহেতু দুজনের রসায়নে মা ও ছেলের একটা অলিখিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাই এমন দুটি বহুমুখী চরিত্রে নৃত্যাভিনয়ে আলাদা অনুশীলনের প্রয়োজন হয়নি।
এথনিক ড্যান্স একাডেমীর ছাত্রছাত্রী।
দ্রাবিণের শিক্ষাগুরু প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী কোহিনূর সেন বরাট বলেন, ছোট থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে আমার কাছে নাচ শিখেছে দ্রাবিণ। ওঁর নিষ্ঠা ও নৃত্যনির্মাণ শৈলীর এক আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা প্রকৃত শিল্পীর পরিচয়। আমার স্থির বিশ্বাস এই অগ্নিপরীক্ষায় ও স্বসম্মানে উত্তীর্ণ হবে। দুই প্রবীণ নৃত্যশিল্পীর কামনা ও দ্রাবিণের আত্মবিশ্বাসের সার্থক রূপায়ণ ঘটল এদিনের অনুষ্ঠানে। পরিপূর্ণ ছিল দর্শক আসন। দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা প্রমাণ করলেন নিষ্ঠা ও নৃত্যশৈলীর প্রতি শ্রদ্ধা সাফল্যের আরেক নাম। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনায় দ্রাবিণ চট্টোপাধ্যায়ের মুন্সিয়ানা ও অক্লান্তা মজুমদার ও রণজয় কুণ্ডুর সংযোজনাও দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ছবি: রাজেন বিশ্বাস