পর্ব:১৬
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: টাইম মেশিনে চড়ে চলুন যাই প্রাচীন ভারতে। সঙ্গী হবে প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ বইটি। লেখিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য। তিনি এই বইতে প্রাচীন ভারতে গণিকা শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন,,,,,,,,, ঋগ্বেদেই ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য এবং এখানেই গণিকাবাচক বেশ কয়েকটিশব্দ পাই: হস্রা, অগ্রূ ( ৪/১৬/১৯/৩০;৪/১৯/৯); সাধারণী( ১/১৬৭/৪;২/১৩/১২,১৫,১৭) এর কিছু পরে অথর্ব বেদে পুংশ্চলী ( ১৫/১/৩৬; ২০/১৩৬/৫)।শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় সাধারণী ও সামান্যা (৩৯/১২); কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতাতেও এই শব্দ দুটি পাওয়া যায়।(৩/৪৭) আরও কিছু পরে নতুন দুটি শব্দ পাই, অতিস্কদ্বরী ও অপস্কদ্বরী, যে ( নিয়ম) উল্লমঘন করে,( তৈত্তিরীয়, ব্রাহ্মণ ৩/৪/১১/১। আর পাই ব্রহ্ময়িত্রী , যে আনন্দ দেয়।( বাজ সনেয়ী সংহিতা ৩০/১; তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/৪/৭/১। পালি বিনয়পিটকে একটি শব্দ পাই! মুহুত্তিয়া ( সংস্কৃত মুহূর্তিকা), যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী।(৩/১৩৮) । জাতকে পাই রূপদাসী, বণ্ণদাসী: বেশ্যা, নারিযের, গামনী ও নগরশোভনী, ইত্থি।১/৪৩/। এবং জনপদ কল্যাণী। এঁদের মধ্যে রূপদাসী ও ব বণ্ণদাসী অন্য প্রধানা গণিকার অধীনে অথবা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থীকে আপ্যায়ন করতে পারত ( অর্থ শাস্ত্র ২/২৭) জাতকেও এঁদের কথা পাই।( পৃষ্ঠা ৫৭)
সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে প্রাচীন ভারতে গণিকা প্রবন্ধে লিখেছেন, এর পরবর্তীকালে গণিকার প্রতিশব্দ সংখ্যায় বেড়েই চলে। মহাকাব্যে পুরাণগুলিতে ও সাহিত্যে যাদের দেখা পাই তাদের নানা নাম – কুলটা, স্বৈরিণী, বারাঙ্গনা, বারস্ত্রী , বারবনিতা,স্বতন্ত্রা ও স্বাধীন যৌবনা। নটী ও শিল্পকারিকাও গণিকার প্রতিশব্দ হিসেবে দেখা দিয়েছে মাঝে মাঝে যেমন কুম্ভদাসী এবং পরিচালিকাও । বাৎস্যায়নের কামসূত্রেগণিকা, রূপাজীবা (৭/৬/৫৪) নাম পাই? জটাধরের শব্দরত্নাবলী অভিধানে পাই শালভঞ্জিকা, বারবাণী, বর্বটি, ভন্ডহাসিনী, কামরেখা, শূলা এবং বারবিলাসিনী । পাই লঞ্জিকা শব্দটিও। বৈশিকতন্ত্রে আরও কিছু নাম আছে। বৃষলী ( যার অভিধাগত মুখ্য অর্থ শূদ্রা এবং যার গৌণ একটি অর্থ গণিকা; শূদ্র নারীকে অন্য বর্ণের ভোগ্যা মনে করা হতো, তাই এতে স্পস্ট)। এছাড়া পাংশূলা ( মলিনা), লঞ্জিকা, বন্ধুরা, কুন্তা ( শূলার মত এও একটি বিদ্ধ করার অস্ত্র) কামরেখা বর্বটি ও রন্ডা ( এ বিটের রক্ষিতা)। হেমচন্দ্রের অভিধান চিন্তামণিতে পাই সাধারণস্ত্রী, পণ্যাঙ্গনা, ক্ষুদ্রা ভুঞ্জিকা ও বারবধূ। রাজনির্ঘণ্ট অভিধানে আছে ভোগ্যা ও স্মরবীথিকা এবং অমরকোষে পাই বেশ্যা, বারস্ত্রী, গণিকা ও রূপাজীবা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বলে একপত্নী, স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্তি নারী কুলটা, তিনজনের প্রতি হলে বৃষ বা পুংশ্চলী, চার থেকে ছ জনের প্রতি হলে বেশ্যা, সাত আট জনের যুঙ্গী, তদূর্ধ্ব মহা বেশ্যা; কোনো বর্ণের লোকই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।( প্রকৃতি খণ্ড, অধ্যায় ২২৭-২২৮)
পরিচারিকা ভোগ বৈদিক যুগে স্বীকৃত প্রথা।
অর্থাৎ পুরুষের যৌন স্বাধীনতা স্বীকৃত সমাজে নারীর যৌন স্বাধীনতা কতজন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক সেই সংখ্যাতত্ত্বে বিভিন্ন নামকরণ হতো। বৈদিক সমাজের রীতি সম্পর্কে কিছু জানা যাক। এই বিষয়ে সহায়ক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমলা দেবী লিখিত ভারতীয় সমাজে প্রান্ত বাসিনী গ্রন্থ। নারী শারীরিক দূর্বল ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে সমাজে বিবেচিত হতো। আজও হয়। তাই ভাত কাপড়ের বিনিময়ে অন্য ঘর থেকে বিয়ের এক রীতির মাধ্যমে গোত্র ও পদবী পাল্টে নারী নিয়ে আসা হয় পুরুষের গৃহে। পুরুষের যৌন আকাঙ্খা পূরণের প্রথম শর্ত নারীকে সুন্দরী যেমন হতে হবে, তেমন শারীরিক গঠনও হতে হবে কামোদ্দীপক। শুধু স্ত্রী নয়, সংসারের কাজে নিযুক্ত পরিচালিকাকেও গৃহস্বামী বা তাঁর যুবক পুত্র ও দোস্ত ইয়ারদের কিংবা বাড়ির অতিথি কেউ এলে তাঁদেরও যৌন সেবা প্রদান করতে হতো। যে নারীকে আবাল্য পালন করে প্রভু তাকে বিয়ে দিয়ে এক বছর পরে আপন গৃহে পরিচালিকার কাজে নিযুক্ত করতেন, তাকে বলা হতো পরিচালিকা। বিবাহিতা হলেও এই নারী প্রভুর অধীনস্থ। কুলটা বলতে বোঝাত এমন নারী, যে পতির অজ্ঞাতসারে প্রচ্ছন্নভাবে গৃহ ত্যাগ করে বহু পরপুরুষের সঙ্গে যৌন সম্ভোগে রত হয়। যে নারী স্বামীর সম্মতিক্রমে বা তাকে অগ্রাহ্য করে পরপুরুষের সঙ্গে যৌন প্রবৃত্তির বশে সঙ্গত হয় তাকে বলা হয স্বৈরিণী। যে নারী নাচ গান বা অভিনয়াদি দ্বারা জীবিকার্জন করত, তাকে নটী আখ্যায় অভিহিত করা হ’ত। এরা আবার বেশ্যাবৃত্তিও অবলম্বন করত। নটী সাধারণত কোন নটকে বিয়ে করত এবং বিয়ের পর বৃত্তি ত্যাগ করত না। দরিদ্র শিল্পীর স্ত্রী অথবা নিজে শিল্পী হয়ে স্বামীর সম্মতিক্রমে বিত্তবান কামুক ব্যক্তির অভিগমন করত তাকে বলা হ’ত শিল্পকারিকা।( চলবে)
আগামী পর্ব: ১৭ , সোমবার ১০ জুন ,২০২৩