বেশ্যার বারোমাস্যা

পর্ব ১৪

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: পর্ব ১৩ শেষে কালিদাসের আমলে গণিকাদের সম্পর্কে বলেছিলাম। গবেষক সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গণিকাবৃত্তি – প্রাচীন ভারত প্রবন্ধে লিখেছেন ,,,,,,,, আর্যরা ছিল যাযাবর পশুপালক। এরা যখন যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে খাদ্য উৎপাদনকারীটে পরিণত হল অর্থাৎ চাষবাস শিখল তখন ফসল ফলানোর জন্য তাদের নিয়মিত বৃষ্টির দরকার হয়। কিন্তু এই বিষয়টিতে তাদের কিছু করার ছিল না। ফলে তারা অলৌকিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হল, যাতে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানালে কার্যসিদ্ধি হয়। এই অস্তিত্বের নামই দেবতা। এরপর প্রতিটি প্রাকৃতিক শক্তিকেই তারা দেবতার স্থান দিতে শুরু করে ইন্দ্রকে দেবতাদের রাজা হিসেবে স্থিত করে। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে তারা যে যাগযজ্ঞের আয়োজন করত তার শেষে অল্প মাত্রায় সোমরস পানের ব্যবস্থা থাকত এবং অনুমান করা যায় যে তার পরে নারী পুরুষ উভয়ে স্বেচ্ছায় পরস্পর মিলিত হতো। যে সমাজে তখন পর্যন্ত বিবাহ প্রথা চালু হয়নি সেখানে এই ধরনের মিলনকে বা সঙ্গী বেছে নেওয়াকে গণিকাবৃত্তি বলা চলে না। কিন্তু এরপর এল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাবনা। উত্তরাধিকারের প্রশ্ন দেখা দিল। তখন পুরুষ তার নিজস্ব নারীকে বেছে নিল, যে কেবল তার সম্পত্তি এবং তারই পুত্রের জন্মদাত্রী হবে। এই পরস্পর সংযুক্ত জীবনযাপন যে উৎসব বা বিধির মাধ্যমে স্বীকৃত হল, তারই নাম বিবাহ। কিন্তু ঋগবেদের মত প্রাচীন সাহিত্যেও গণিকাবাচক কয়েকটি শব্দ আমরা পাই। যেমন হস্রা, অগ্রূ, সাধারণী । তাছাড়া ঋগবেদে জার ও জারিনা শব্দ অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে। এটা ছিল বিবাহিত পুরুষ/ নারীর বহির্ভূত সম্পর্ক। একে অবৈধ সম্পর্ক বলা চলে, কিন্তু গণিকা পর্যায়ভুক্ত নয় এটি। যজুর্বেদে গণিকাবাচক সামান্যা ও সাধারণী শব্দদুটি পাওয়া যায়।

ভারতীয় সমাজে প্রান্ত বাসিনী গ্রন্থের যুগ্ম লেখক সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ও রমলাদেবী ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশে নারীর স্থান পর্বে লিখেছেন,,,,, মহাব্রু নামক বৈদিক যজ্ঞে একজন ছাত্র ও গণিকার মধ্যে গর্ভোৎপাদন বিষয়ে অশ্লীল গালাগাল হত এবং পরে যৌন সম্ভোগ ঘটত। গোসব যজ্ঞে ( জৈমিনিয় ব্রাহ্মণ ২/১১৩) যজমান একটি ষাঁড়কে তৎসংশিষ্ট সব গরুকে গর্ভবতী করে বলে প্রশংসা করতেন, তারপর তিনিও ষাঁড়ের অনুকরণে স্ত্রীলোকদের সঙ্গে যৌনসম্ভোগে প্রবৃত্ত হতেন। ( পৃষ্ঠা ৪৭,সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার)। লেখকদ্বয় লিখেছেন, ব্রাহ্মণ যুগে স্বয়ংবর প্রথা প্রচলিত ছিল।( ঐতেরিয় ৪/১৭/১)। পুরুষের বহু বিবাহের প্রচলন ছিল বলে মনে হয় ( ঐতেরেয় ৭/৩৩)। স্ত্রীলোকের বহুপতিত্ব নিষিদ্ধ হয়েছে ( যথা ঐতেরেয় ৩/১২/১২, গো পথ ৩/২০)। শ্বশুরের সমক্ষে পুত্রবধূর আসা নিষিদ্ধ ছিল। স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে ধারনা ছিল যে এরা চপলমতি, এঁদের সঙ্গে মৈত্রী অসম্ভব ( শতপথ ৩/২,৪/৬,১২/৫/১/৯)। এঁরা লিখেছেন, কাম যে মানুষকে কট নিচে নামিয়ে দেয়, তার একটি উদাহরণ নিজে কন্যাকে প্রজাপতির সম্ভোগ করার তীব্র আকাঙ্খা। এই আখ্যান আছে শতপথ ( ১/৬/৪)১-৮) ঐতেরেয়(৩/৩৩/৩৪) ও পঞ্চ বিংশ ব্রাহ্মণে (৮/২/১০)।

যৌনতা শুধু নারী গণিকাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ভাবাটা ভুল হবে। সেযুগে নারীতে নারীতে যৌনতার নিদর্শন আছে। প্রসঙ্গ নারী সমকাম একটি পাঠ নামে এক গ্রন্থে কিছু প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। সম্পাদিকা সানন্দা সেন ও সহকারী সম্পাদিকা পিয়ালী হালদার। সেই গ্রন্থে সমকালীন ভারতীয় ( গদ্য) সাহিত্যে সমকামী নারীর উপস্থাপনা ১৯৯০-২০২০ শীর্ষক প্রবন্ধে সায়নী ব্যানার্জি লিখেছেন, সমকামিতা ও প্রচলিত সংজ্ঞার সীমারেখার বাইরে স্বচ্ছন্দে রয়েছেন প্রাচীন ভারতবর্ষে রচিত বহু সাহিত্যের নারী চরিত্রেরা। মল্লনাগ বাৎসায়ন রচিত কামসূত্র স্পষ্টভাবে বলে তৃতীয় প্রকৃতির কথা, যাঁরা নারী পুরুষের দ্বৈততার উর্ধ্বে আছে পুরষায়িতা বা পুরুষ সুলভ নারীদের কথা। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণে বর্ণিত আছে লংকাধিপটি রাবণের প্রাসাদে রাক্ষস নারীদের পারস্পরিক চুম্বনের দৃশ্য। আবার কৃত্তিবাসী রামায়ণে এমন একটি কাহিনী আছে, যেখানে বেদুই বিধবা রমণী কোনো এক জাদুকরী ঔষধ সেবন করে পরস্পর রতিক্রিয়ায় মগ্ন হয় এবং অস্থিবিহীন এক সন্তানের জন্ম দেয়। ( চলবে)।

আগামী পর্ব ১৫ , সোমবার ২৭ মে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *