পর্ব: ৮
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আগের পর্বে কথা হচ্ছিল ১৯ শতকে বাবু কালচারের কথা। একদিকে উদ্দাম যৌনতা অন্যদিকে বিদেশি সুরা আর বারো মাসে তেরো পুজো পাব্বন ও সংস্কৃতি চর্চা। কাজটা আর তাঁদের ছিল কি?
স্বদেশ চর্চালোক শারদ ২০১৬ আদিরস সেকাল একাল গ্রন্থে কিশলয় জানা তাঁর উনিশ শতকের বাবুদের বাগান সংস্কৃতি শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছেন,,,,,, ১৮২৩সালে কলিকাতা কমলালয় নামক গ্রন্থে বিষয়ী ভদ্রলোকের যে স্তরবিন্যাস করেন ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায় , তাঁদের তিনি পেয়েছেন মূলত নাগরিক কোলকাতার বৃত্ত থেকে। এঁদের মধ্যে দু ধরণের শ্রেণীকে চিহ্নিত করা যায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে ।বাকি দুই শ্রেণীর মধ্যে প্রথম হলেন যাঁহারা প্রধান প্রধান কর্ম অর্থাৎ দেওয়ানী বা মুচ্ছুদ্দিগিরি কর্ম করিয়া থাকেন এবং স্নান আহ্নিক ভোজন সেরে দুপুরবেলায় নিজ নিজ গাড়ি ঘোড়াতে সওয়ার হয়ে কর্মস্থলে পৌঁছান। সন্ধ্যেয় ঘরে ফিরে জলখাবার খেতে পুনর্বার বৈঠক হয়, পরে অনেক লোকের সমাগম হইয়া থাকে, কেহ কোনও কর্মপোলক্ষে , কেহ বা কেবল সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আইসেন অথবা তিনি কখনকাহারও সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করেন ইত্যাদি।
দ্বিতীয় শ্রেণী হইলেন ভবানী চরণের ভাষায় যথার্থ ভাগ্যবান ব্যক্তি , ভগবানের কৃপাতে যাঁহারদিগের প্রচুর তর ধন আছে সেই ধনের বৃদ্ধি অর্থাৎ সুদ হইতে কাহার বা জমিদারির উপসত্ব হইতে ন্যায্য ব্যয় হইয়াও উদ্বৃত্ত হয় তাঁহারা প্রায় আপন আলয়ে থাকিয়া পূর্বোক্ত রীতানুসারে সন্ধ্যা বন্দনাদি পূর্বক মধ্যাহ্নকালে ভোজন করিয়া প্রায় অনেকেই নিদ্রা যান। চারি বা ছয় দণ্ড নেলা সত্বে আপন বিষয়ে দৃষ্টি করেন কেহবা পুরাণাদি শ্রবণ করিয়া থাকেন ইত্যাদি। লক্ষণীয় উভয়ে ক্ষেত্রেই বাবুদের নৈশকালীন বিনোদনের ক্ষেত্রে ভবাণীচরণ সাঁটে সেরেছেন। প্রথম শ্রেণীর বাবুরা রাত্রিবেলা কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান এই ইঙ্গিত যেমন অর্থবহ , তেমনি দ্বিতীয় শ্রেণীর বাবুদের দল নৈশকালে কোনও পুরাণ শ্রবণ করেন এবং ইত্যাদি বলতে আর কোন কোন কর্ম তাঁদের আসক্তি আছে, সে বিষয়ে খোলসা করে কিছু না বললেও, পাঠকদের বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয় না।,,,,, এঁদের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা অষ্টাদশ শতকে পলাশীর যুদ্ধের পর-পরই, এঁরাই হলেন আধুনিক বাংলার আদি বাবু।
কিশলয় জানা লিখছেন ইংরেজি বাংলা সংবাদপত্রে বাবুদের আচরণের নিন্দা শুরু হয়ে এই সময় থেকে। হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা বলে মন্তব্য করে ক্যালকাটা জার্নালের মতো সম্ভ্রান্ত কাগজে পূজা আয়োজক বাবুদের রুচির নিন্দা করা হয়েছে, বলা হয়েছে ,these festivals impart an irresistible impulse to the progress and the inveterary of immorality and vice one’ halfway the money is ecpended in midnight revelry,in songs so obdcence and filthy,,,,,,,,। যদিও বাবুরা এসব নিন্দায় কর্ণপাত করেননি বলা বাহুল্য। অনেক সাহেবরাও এই উপলক্ষে obscene and filthy নাচগানের আসরে উপস্থিত হতেন এবং অনেকসময় আবার এঁদের জন্যই এক জাতীয় নাচ- গানের আসরের ব্যবস্থা করতেন বাবুরা। বিষয়টি বাংলায় নব্য বাবুদের আবিষ্কার ভাবাটা ভুল হবে। হিন্দু ধর্মে পুরাণে ভুরি ভুরি আদিরসের বর্ণনায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন বাবুরা।
লিঙ্গ পুরাণে চোখ রাখা যাক বাংলা ও বাঙালি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার ২০১২ সালের প্রথম বর্ষের ১৯/২১ সংখ্যায় সন্দীপ ঘোষ লিঙ্গ পুরাণে বেশ্যা প্রতিবেদনে লিখেছেন,,,,,,, শিব লিঙ্গ শব্দটি নিয়ে তন্ত্র ও পুরাণকাররা নিজেদের উৎকট রুচির পরিচয় তো দিয়েছেনই , সময় সময় তা নীল সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না।লিঙ্গ অর্থে বহু কিছু ও শিব অবৈদিক দেবতা হওয়ার জন্য এই অশ্লীলতা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সত্যিই শুধু লিঙ্গ পুরাণ কেন ছবি পুরাণ গ্রন্থেই অশ্লীলতা জল ভাত। প্রথম পর্বেই বলেছিলাম, বাৎস্যায়নের চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী অসামান্য রূপবতী, গুণবতী শিলবতী কম্ভদাসী রূপাজীবী, পরিচারিকা , কুলটা স্বৈরিণী, নটী, শিল্পকারিকা, প্রকাশবিনষ্টাকে গণিকা বলা যায়। কিন্তু এঁদের বেশ্যা বলা যায় না। তাহলে বেশ্যা কারা? বিস্ফোরক তথ্য, কালী , তারা ত্রিপুরা ইত্যাদি দশমহাবিদ্যা ও তাঁদের আবরণ দেবতাকেই বেশ্যা বলা হয়।
শাস্ত্রে আবার বেশ্যা ভিন্নার্থক পরিভাষিক শব্দ। পন্ডিতদের বক্তব্য, বেশ্যাদের গৃহের দরজা পূণ্যশোষী।পুরুষের জীবনের পুণ্য বেশ্যার ঘরের চৌকাঠ পেরোলে চৌকাঠ তা শোষণ করে নেয়। সব পুরুষের পূণ্য বেশ্যার দ্বারে জমা হয়ে। তাই দুর্গাপূজায় বেশ্যাদ্বারের মাটি আজও পুজোর উপাচার। নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েরা বিষয়টি নিয়ে গর্ববোধ করে। আসলে যে এটি অপমান তাঁদের কে বোঝাবে?( চলবে)